অথবা,মহাসনদ কী?
অথবা ,মহাসনদ সম্পর্কে কী জান লিখ।
উত্তরঃ ভূমিকা: পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শাসনতন্ত্রের উদ্ভবের ইতিহাসের ন্যায় ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থার উৎপত্তিরও রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। বর্তমান গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধান থেকে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নতি পরিলক্ষিত হয় তা সুদীর্ঘকালের ক্রমবিবর্তনের ফল। যুগ যুগ ধরে দেশ ও দেশবাসীর ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে ব্রিটিশরা, বিপ্লব, বিবর্তন, ও নানা ধরনের উত্থান পতনের দ্বারা শাসনতন্ত্রের বর্তমান রূপটি প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর যেসব বিপ্লব বা বিবর্তনের দ্বারা ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন লাভ করেছে তার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ম্যাগনাকার্টা বা মহাসনদ।
মহাসনদ: একাদশ শতক থেকেই মূলত ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের সূচনা হয়। ১০৬৬ সালে নর্মান্ডির উইলিয়াম ইংল্যান্ড অধিকার ও নিজের শাসন ক্ষমতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সামন্তপ্রথার প্রবর্তন করেন। এ প্রথা অনুযায়ী তাঁর আস্থাভাজন ব্যক্তিদের মধ্যে দেশের সকল জমি বণ্টন করে দেন। সম্পত্তির বিনিময়ে সামন্তগণ বাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে এবং রাজাকে কর প্রদান থেকে শুরু করে সৈন্যবাহিনী দিয়েও সকল কাজে সহযোগিতা করেন। ফলে সামন্তদের সাথে রাজার ঐক্য ও সম্প্রীতি গড়ে উঠে ও দেশে শান্তি শৃঙ্খলা বিবাজ করে। কিন্তু সামন্তদের সাথে রাজার সম্প্রীতি ও ঐক্য পরবর্তীকালে আর বেশিদিন অক্ষুন্ন থাকে নি। বিশেষ করে যুদ্ধের বিপুল ব্যায়ভার রাজার উপর এমন চাপ সৃষ্টি করেছিল যে, সামন্তদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর ধার্যের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ করা ব্যতীত রাজার সামনে আর কোন বিকল্প ছিল না। অন্যদিকে সামন্তগণও রাজার ক্ষমতা সংকোচন করে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়ে উঠেছিল। আর পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয়ে উঠেছিল তের শতকে দ্বিতীয় হেনরির পুত্রদ্বয় রিচার্ড ও জনের বেখেয়ালি ও স্বৈরাচারীতে। বিশেষত রাজ। জনের স্বেচ্ছাচারমূলক কার্যকলাপে ভূস্বামীগণ অতিষ্ঠ হয়ে রাজার ক্ষমতার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ব্যাপারে উদ্যোগী হন। ১২১৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা জনের আমলেই বৃহত্তর পরিবদে প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার সূত্রপাত হয়। ঐবছর রাজা জন প্রত্যেকটি কাউন্টি থেকে চারজন করে নাইট বৃহত্তর পরিষদে পাঠাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। শহড়া এই পরিষদে ছোট ছোট ভূ-স্বামীদেরকেও আহ্বান করা শুরু হয়। বৃহত্তর পরিষদে নতুন নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে এই পরিষদের সদস্যসংখ্যা ও আয়তন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। তারপর ১২১৫ সালের ১৫ জুন রুনিমিড গাওয়ে রাজা জন ও ব্যারণদের মধ্যে এক সনদ স্বাক্ষরিত হয়। এই সনদই ইতিহাসে ‘মহাম্মদ’ বা ম্যাগনাকার্টা নামে পরিচিত।
সনদের চুক্তিসমূহ: “মহাসনদের” মাধ্যমে সর্বপ্রথম রাজার কর্তৃত্বের উপর হস্তক্ষেপ করা হয়। রাজা জন এই দলিলে ব্যারণদের বহুবিদ দাবি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেন। এগুলো নিম্নরূপ:
i.বৃহত্তর পরিষদের সম্মতি ছাড়া রাজা কতকগুলো বিশেষ কর আদায় করতে পারবে না।।
ii. রাজা কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে বিনা বিচারে বা বেআইনিভাবে গ্রেপ্তার করতে, নির্বাসন দিতে বা সম্পত্তিচ্যুত করতে পারবে না।
iii. রাজার ক্ষমতা সীমাহীন নয়, প্রচলিত আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধ। ক্ষমতার অপব্যবহার করলে রাজাকে
বাধা দেয়া হবে।
iv. যে কোন ক্ষেত্রে “মহাসনদই” হবে চূড়ান্ত দলিল এবং মহাসনদেই চুক্তিসমূহ সবসময় বলবৎ থাকবে। কেউ এই শর্তসমূহ ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা হতে “মহাসনদের” গুরুত্ব কতটুকু তা যথাযথভাবে উপলব্ধি করা যায়। বিশেষ করে এই সনদে ঘোষণা করা হয় যে বৃহত্তর পরিষদের সম্মতি ছাড়া রাজা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেতে পারবে না। এই ঘোষণাই পরবর্তীকালে ব্রিটেনের জনসাধারণের ব্যক্তিস্বাধীনতা অর্জনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার পথে “মহাসনদ” ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই সনদের ফলেই শ্বৈরাচারী ব্যবস্থার পরিবর্তে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার পথ প্রশস্ত হয়। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় বর্তমানে ব্রিটেনের যে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র তা মূলত মহাসনদেরই ফল।