মনোবিজ্ঞানে পরীক্ষণ বলতে কী বুঝায়? একটি পরীক্ষণ পরিচালনায় অনুসৃত ধাপগুলো আলোচনা কর।

অথবা, পরীক্ষণ কী? পরীক্ষণের বিভিন্ন ধাপসমূহ সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, মনোবিজ্ঞানে পরীক্ষণ কী? একটি পরীক্ষণ পরিচালনায় অনুসৃত কী কী ধাপ অনুসরণ করা হয়?
অথবা, পরীক্ষণ বলতে কী বুঝ? পরীক্ষণের ধাপসমূহ বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, পরীক্ষণ কী? পরীক্ষণের স্তরগুলো আলোচনা কর।
অথবা, পরীক্ষণ কী? পরীক্ষণের বিভিন্ন পর্যায় আলোচনা কর।
উত্তর।। ভূমিকা : মনোবিজ্ঞানে ব্যবহৃত পদ্ধতিসমূহের মধ্যে পরীক্ষণ পদ্ধতি সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত। মূলত পরীক্ষণ পদ্ধতির সাহায্যে মনোবিজ্ঞান থেকে পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানের উদ্ভব ঘটেছে। পরীক্ষণ পরিচালনা করতে গেলে কতকগুলো ধাপ বা পর্যায় মেনে চলতে হয়। এসব ধাপ বা পর্যায়গুলো সঠিকভাবে মেনে চললে পরীক্ষণের সুষ্ঠু ফলাফল পাওয়া যায়, যার মাধ্যমে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়।
মনোবিজ্ঞানে পরীক্ষণ : পরীক্ষণ হল একটি গবেষণা পদ্ধতি, যেখানে অনুসন্ধানকারী কতকগুলো নির্দিষ্ট চল প্রয়োগ করেন এবং অন্যান্য চলের উপর তাদের প্রভাব পরিমাপ করেন। মনোবিজ্ঞানী Barry F. Anderson বলেছেন, “পরীক্ষণ হল এমন একটি অবস্থা, যেখানে কেউ দু’টি চলের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য একটির মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন এনে দেখেন এর ফলে অন্যটির মধ্যে কোন পরিবর্তন সাধিত হয় কি না।”
Wayne Weiten বলেছেন, “The experiment is a research method in which the investigation manipulates a variables by deliberately producing a change in one and looking to see whether this alteration produces a change in the other.” (Source : The Psychology Experiment, 1966)
অতএব, যে পদ্ধতির সাহায্যে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরীক্ষণ পাত্রের উপর কোন উদ্দীপকের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গবেষণা করা হয় এবং পরিসংখ্যানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়, তাকেই মনোবিজ্ঞানের ভাষায় পরীক্ষণ বলা হয়। অর্থাৎ, মনোবিজ্ঞানের কোন সমস্যাকে বারবার গবেষণা, বিশ্লেষণ এবং সুষ্ঠু ফলাফল লাভের প্রক্রিয়াই পরীক্ষণ।
পরীক্ষণ পরিচালনায় অনুসৃত ধাপ বা পর্যায়সমূহ : পরীক্ষণের বিষয় ও এর সমস্যার উপর নির্ভর করে পরীক্ষণ কেমন হবে। যদি পরীক্ষণের সমস্যা জটিল হয়, তাহলে পরীক্ষণে সুষ্ঠু ফলাফল পেতে বেশ বেগ পেতে হবে। যে কোন পরীক্ষণ
পরিচালনা করার জন্য কতকগুলো পর্যায় বা ধাপ অনুসরণ করতে হয়। নিম্নে সে ধাপগুলো আলোচনা করা হল :
১. দক্ষ গবেষক : পরীক্ষণ পরিচালনার জন্য সর্বপ্রথম দরকার একজন দক্ষ গবেষক। কেননা, চল নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গবেষকের ভূমিকাই অগ্রগণ্য। গবেষক যদি দক্ষ না হন, তাহলে সঠিকভাবে চল নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না এবং গবেষণার ফলাফলও ভালো আসবে না। তাই দক্ষ গবেষকের উপরই পরীক্ষণ সর্বাধিক নির্ভরশীল ।
২. পরীক্ষণের পরিকল্পনা : পরীক্ষণ পরিচালনা করার আগেই গবেষককে সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। কেননা,সুষ্ঠু পরিকল্পনার উপর পরীক্ষণের ফলাফল বহুলাংশে নির্ভরশীল। পরীক্ষণ সম্পন্ন করার জন্য একজন গবেষককে নিম্নে উল্লিখিত পরিকল্পনাগুলো অবশ্যই নির্ধারণ করতে হবে। যথা :
ক. পরীক্ষণের নামকরণ : পরীক্ষণের নামকরণ হবে সহজ ও সুস্পষ্ট, যাতে পরীক্ষণের উদ্দেশ্য ও চলসমূহ সম্পর্কে ইঙ্গিত থাকবে। পরীক্ষণের নামকরণ অবশ্যই সংক্ষিপ্ত হতে হবে।
খ. প্রকল্প প্রণয়ন : গবেষক যদি দক্ষ হন, তাহলে প্রকল্প অবশ্যই দক্ষ হবে। গবেষণার সমস্যা সম্পর্কে গবেষক পরীক্ষণ পরিচালনার পূর্বেই সমস্যা সম্পর্কে একটি পূর্ব অনুমান বা প্রকল্প প্রণয়ন করতে হবে। যেমন- বাংলাদেশে ১৬ বছরের একজন কিশোরী একজন কিশোরের চেয়ে যৌনতা সম্পর্কে অধিক সচেতন। এ সমস্যাটির প্রকল্প হবে “কিশোরের চেয়ে কিশোরীরা দ্রুত যৌনতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে।”
গ. পরীক্ষণ নকশা : পরীক্ষণ বা গবেষককে সমস্যার উপযোগী একটি নকশা নির্ধারণ করতে হবে এবং নকশা প্রণয়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই যুক্তি থাকতে হবে। কেননা, সঠিকভাবে নকশা প্রণয়ন করতে না পারলে উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ ত্রুটিপূর্ণ হয়।
৩. পরীক্ষণের যন্ত্রপাতি : পরীক্ষণ পরিচালনা করার জন্য যন্ত্রপাতি অবশ্যই প্রয়োজন। কেননা, যন্ত্রপাতি ছাড়া বর্তমানে কোন পরীক্ষণ বা গবেষণা সম্পন্ন হয় না। মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর আচরণের উপর নিরপেক্ষ চলের প্রভাব লক্ষ্য করার জন্য স্থায়ী যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। কোন পরীক্ষণের নিরপেক্ষ চলকে উপস্থাপন করার জন্য কি কি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে তার সুস্পষ্ট বর্ণনা দিতে হবে, যাতে পরবর্তীতে কোন গবেষক পরীক্ষণটির পুনরাবৃত্তি করতে চাইলে তিনি প্রতিবেদনটির বর্ণনা থেকে যন্ত্রপাতি সম্পর্কে ধারণা পান।
৪. পরীক্ষণ পাত্র নির্বাচন : প্রকল্পের সত্যতা নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষণ পাত্র নির্বাচন করা প্রয়োজন। পরীক্ষণ পাত্র বলতে যাদের উপর পরীক্ষণ পরিচালনা করা হয়, তাদেরকে বুঝায়। পরীক্ষণ পাত্র এককভিত্তিক কিংবা দলীয় যে কোন প্রকার হতে পারে।
৫. চলের নিয়ন্ত্রণ : গবেষকের আরেকটি অন্যতম দায়িত্ব হল পরীক্ষণ চলের নিয়ন্ত্রণ। পরীক্ষণে সমস্যা নির্ধারণ, যন্ত্রপাতি স্থাপন এবং পরীক্ষণ পাত্র নির্বাচনের পর গবেষককে চল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কেননা, গবেষককে মানুষ বা প্রাণীর আচরণের উপর নিরপেক্ষ চলের প্রভাব লক্ষ্য করতে হবে। পরীক্ষককে অবশ্যই নির্ভরশীল চল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কেননা, বাহ্যিক চল বা
অনির্ভরশীল চল পরীক্ষণে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য গবেষককে খুব সাবধানভাবে চল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৬. পরীক্ষণের কার্যক্রম পরীক্ষণের চল নিয়ন্ত্রণ করার পর গবেষক তার পরীক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে পারে।গবেষক যেভাবে তথ্য সংগ্রহ করার পরিকল্পনা নিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই তিনি কাজ করবেন। পরীক্ষণ ছাত্রদের কি করতে হবে সে সম্পর্কে গবেষককে নির্দেশ দিতে হবে এবং পরীক্ষণ নকশা অনুযায়ী পরীক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে।
৭. উপাত্ত সংগ্রহ : পরীক্ষণ কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর গবেষককে উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। উপাত্ত সংগ্রহ করার সময় গবেষককে গোপনীয়তা ও সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে সঠিক ও নির্ভুল উপাত্ত পাওয়া যায়।
৮. ফলাফলের সাধারণীকরণ : পরীক্ষণ প্রাপ্ত ফলাফলকে প্রকল্পের সাথে তুলনা করে একটি সাধারণ সিদ্ধান্তে আসতে হবে এবং সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে হবে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত্রে বলা যায় যে, মনোবিজ্ঞানে পরীক্ষণ পরিচালনার ক্ষেত্রে উপরিউক্ত ধাপ বা পর্যায়গুলো অবশ্য পালনীয়। একটি পরীক্ষণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হলে তা যথার্থ নিয়মানুযায়ী সম্পন্ন করতে
হবে। পরীক্ষণের কারণেই মূলত মানবকল্যাণে মনোবিজ্ঞানের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই মনোবিজ্ঞান গবেষণা করার জন্য পরীক্ষণের উপরিউক্ত ধাপগুলো অনুসরণ করা প্রত্যেক গবেষকের একান্ত প্রয়োজন।