অথবা, মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রগুলো কী কী?
উত্তর৷ ভূমিকা : মনোবিজ্ঞান হলো আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়ার বিজ্ঞান আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়া নিয়েই মানবজীবন। মানুষকে জানতে হলে তার আচরণ ও মানসিক কার্যকলাপ বুঝতে হবে। আর মানুষের আচরণ ও মানসিক কার্যকলাপ বুঝতে হলে মনোবিজ্ঞান সম্বন্ধীয় জ্ঞানের প্রয়োজন। দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হই। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান খুবই প্রয়োজন। ঘুম থেকে জেগেই শুরু হয় বিভিন্ন আচরণ ও মানসিক কার্যকলাপ । নিদ্রা যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তা চলতে থাকে। জাগ্রত ও নিদ্রিত উভয় অবস্থায়ই আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়া সক্রিয় রয়েছে। তাই যেখানেই আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়ার প্রকাশ, সেখানে রয়েছে মনোবিজ্ঞানের অস্তিত্ব।মনোবিজ্ঞানের শাখা প্রশাখা নিয়ে মনোবিজ্ঞানের প্রধান শাখাগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. সাধারণ মনোবিজ্ঞান : মনোবিজ্ঞানের প্রাথমিক বিষয়সমূহ মূলত সাধারণ মনোবিজ্ঞানের মূল উপজীব্য বিষয়। সাধারণ মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা যা আলোচনা করে তা সংক্ষেপে বর্ণনা করে। তাই সাধারণ মনোবিজ্ঞানের সকল শাখার সম্মিলিত রূপ বা কেন্দ্রীয় সমন্বয় কেন্দ্র বলা যেতে পারে। আচরণ ও মানসিক কার্যাবলি সংক্রান্ত মৌলিক বিষয়গুলো, যেমন- প্রেষণা, শিক্ষণ, স্মৃতি বিস্মৃতি, প্রত্যক্ষণ, বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব, চিন্তন, আবেগ প্রভৃতি সাধারণ মনোবিজ্ঞানের অন্তর্গত।
২. পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান : পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা। মনোবিজ্ঞানের এ শাখায় পরীক্ষণ পদ্ধতির সাহায্যে উপাত্ত সংগ্রহ করে তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা হয়। পরীক্ষণ পদ্ধতিতে সুব্যবস্থিত ও সুপরিকল্পিত অবস্থায় সুনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরীক্ষণ পাত্রের উপর উদ্দীপকের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গবেষণা করা হয়। পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জীবের আচরণের মৌলিক কারণ খুঁজে বের করা হয়। আচরণ সম্পর্কিত প্রায় সকল তত্ত্বই পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। :
৩. ক্লিনিক্যাল মনোবিজ্ঞান মানসিক রোগের চিকিৎসার ইতিহাস বেশ পুরাতন প্রাচীনকালে মানসিক রোগীকে স্বাভাবিক মানুষ থেকে আলাদাভাবে দেখা হতো। মনে করা হতো তাদের উপর ডাইনি বা অশরীরী শক্তি বা অপদেবতা ভর করেছে। বর্তমানে ঐসব প্রাচীন ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। অস্বাভাবিক আচরণের গতিপ্রকৃতি ও তার ব্যাখ্যা, মানসিক রোগের লক্ষণ, কারণ ও তার চিকিৎসা পদ্ধতি প্রভৃতি চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানের মূল বিষয়।
৪. শিক্ষা মনোবিজ্ঞান: শিক্ষা মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা। মনোবিজ্ঞানের এ শাখায় মানুষের শিক্ষা সম্পর্কিত আচরণের বিভিন্ন সমস্যার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা হয় এবং এগুলোর সমাধানে মনোবিজ্ঞানের মূলনীতিসমূহ কিভাবে প্রয়োগ করা যায় সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত মানুষের সব ধরনের আচরণই শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত।
৫. শিল্প মনোবিজ্ঞান : মনোবিজ্ঞানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ। ফলিত শাখা হলো শিল্প মনোবিজ্ঞান। শিল্পকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করার লক্ষ্যে শিল্প মনোবিজ্ঞানের উদ্ভব ঘটেছে। শিল্পকারখানায় শ্রমিক নিয়োগ, কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী উপযুক্ত লোক নির্বাচন, তাদের প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি ও মূল্যায়ন প্রভৃতি শিল্প মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে কর্মচারীদের দক্ষতা, মনোবল ও কর্মসন্তুষ্টি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাই কর্মচারীর দক্ষতা ও মনোবল বৃদ্ধি এবং কর্মে সন্তুষ্টি বিধান শিল্প মনোবিজ্ঞানের লক্ষ্য।
৬. বিকাশ মনোবিজ্ঞান : বিকাশ মনোবিজ্ঞান হলো মনোবিজ্ঞানের সে শাখা, যেখানে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন এবং ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সেসব পরিবর্তনের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। মনোবিজ্ঞানের এ শাখা শুধু বয়স অনুযায়ী আচরণের বিবরণ প্রদান করে তা নয়, এটি বিভিন্ন বয়সে ব্যক্তি ভেদে আচরণে যে পার্থক্য দেখা দেয় তার অন্তর্নিহিত কার্যকারণ সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে।
৭. শিশু মনোবিজ্ঞান : শিশু মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের | একটি অন্যতম শাখা। এ শাখা শিশুর বিকাশ ও বৃদ্ধি সম্পর্কে আলোচনা করে। মাতৃগর্ভে থাকালীন সময় থেকে শুরু করে যৌন পরিপক্কতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত শিশু মনোবিজ্ঞানের বিস্তৃতি। বয়স বাড়ার সাথে শিশুর যে শারীরিক বৃদ্ধি ঘটে এবং শারীরিক বৃদ্ধির ফলে তার আচরণে কি পরিবর্তন ঘটে তা শিশু মনোবিজ্ঞানের মূল আলোচ্যবিষয়।
৮. সামাজিক মনোবিজ্ঞান : মানুষ সামাজিক জীব। তাকে সমাজে বসবাসের উপযোগী আচরণ করতে হয়। মানুষের সামাজিক আচরণই সমাজ মনোবিজ্ঞানের মূল বিষয়বস্তু। সমাজে বাস করার সময়ে একের সাথে অন্যের ভাব বিনিময় হয়, পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ঘটে। কি প্রক্রিয়ায় শিশুর সামাজিকীকরণ ঘটে, সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলো কিভাবে কাজ করে কিভাবে মনোভাব গড়ে উঠে ।
৯. শারীরিক মনোবিজ্ঞান : উদ্দীপকের প্রতি সাড়া দেওয়া জীবের বৈশিষ্ট্য। উদ্দীপকের প্রতি সাড়া বা প্রতিক্রিয়াই হলো আচরণ। আর আচরণের মূলে রয়েছে শারীরিক ভিত্তি। কোন আচরণের মূলে কোন শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জড়িত তা physiological psychology আলোচনা করে। পরিবেশের সাথে সুষ্ঠু সংগতিবিধান শরীরাভ্যন্তরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যাবলির উপর নির্ভর করে। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এ পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর অভিজ্ঞতা লাভ করি।
১০. নির্দেশনা ও পরামর্শ মনোবিজ্ঞান : দৈনন্দিন জীবনে মানুষ হাজারও সমস্যার সম্মুখীন হয়। সঠিকভাবে সমস্যাগুলোর সমাধান করতে না পারলে দেখা দেয় হতাশা। তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। এমনিতর মৃদু আচরণ সমস্যার সমাধানের নিমিত্তে গড়ে উঠেছে Counseling and guidance psychology. মৃদু আচরণজনিত সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি যখন কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন তাকে Counseling and guidance psychologist এর দ্বারস্থ হতে হয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মনোবিজ্ঞানের বিচরণ রয়েছে। মনোবিজ্ঞানের পরিধি, শাখাপ্রশাখা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক কথায় বলা যেতে পারে, এ জগতের যা কিছু মানুষের সাথে সম্বন্ধযুক্ত তার সবই মনোবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত।