অথবা , মধ্যযুগের রাষ্ট্রদর্শনের বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যাখ্যা কর ।
অথবা , মধ্যযুগের রাষ্ট্রমতবাদের তাৎপর্যসমূহ মূল্যায়ন কর ।
উত্তর ৷ ভূমিকা : রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসকে মোটামুটিভাবে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করার রেওয়াজ সর্বজনস্বীকৃত । এগুলো হচ্ছে প্রাচীন যুগ , মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ । রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মধ্যযুগ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় । মধ্যযুগের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের ভাঙা – গড়ার ইতিহাস । রোমান যুগের পর তথাকথিত অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের শুরু হয় এবং প্রায় ভাঙা – গড়ার মধ্য দিয়ে ৪৭৬-১০০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত । এ অন্ধকার যুগ হেলেনিজম , রোমান , রাজনৈতিক সমাজ ও সংগঠন , খ্রিস্টীয় চার্চ প্রভৃতির সংমিশ্রণের দ্বারা প্রভাবিত হয় । এ সময় ধর্মীয় বিশ্বাসের সময় । এ সময় যুক্তিতর্কের চেয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামির উপর বেশি প্রাধান্য দেয়া হয় ।
মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্যসমূহ : রাজনৈতিকমুক্ত , অবৈজ্ঞানিক ও অসৃজনশীল মধ্যযুগের বেশকিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে । এ বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. বিশ্বজনীনতা : মধ্যযুগের চিন্তাধারার অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো বিশ্বজনীনতা । সমগ্র বিশ্বজুড়ে যে এক সমাজ এ ধারণা সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী প্রাণবন্ত ছিল ।
২. স্টোয়িকবাদের প্রভাব : মধ্যযুগের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় স্টোয়িকবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । স্টোয়িকবাদের ন্যায় মধ্যযুগের রাজনৈতিক দর্শনও প্রাকৃতিক আইন , ঈশ্বরের শাসন , সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান ইত্যাদি ধারণায় আস্থাবান ছিল ।
৩. প্রশাসনিক দুর্বলতা : দেখা যায় সাম্রাজ্যে জার্মানদের প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেই সুষ্ঠু রাষ্ট্র চর্চার বিকাশ হয় নি । এখানে প্রশাসনে কোন সুষ্ঠু নিয়মনীতি ছিল না । ফলে প্রশাসন ব্যবস্থা বিকাশ করা অসম্ভব ছিল ।
৪. পোপের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি : আধ্যাত্মিক ক্ষেত্র অতিক্রম করে চার্চের পোপেরা জাগতিক ব্যাপারে বিশেষত সম্রাটদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলে মুক্ত রাষ্ট্র চর্চা বন্ধ হয়ে যায় ।
৫. দুর্ধর্ষ দস্যুদের আক্রমণ : রোম জয়ের পর হতে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত লোসার্ডের ন্যায় দুর্ধর্ষ দস্যুদের আক্রমণে ইউরোপের প্রায় সর্বত্র আইনশৃঙ্খলার দারুণ অবনতি ঘটে যা রাজনীতিতে বিরাট বাধার সৃষ্টি হয় ।
৬. সামন্তবাদ : সামন্তবাদ ছিল মধ্যযুগের টিউটনদের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান । সামন্তবাদ ছিল মধ্যযুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । অধ্যাপক সেবাইনের ভাষায় , “ নগররাষ্ট্র যেমন প্রাচীন যুগে কর্তৃত্ব করত তেমনি সামন্তবাদও মধ্যযুগে প্রভাব বিস্তার করত ।
৭. রাজনীতি বিষয়ক পুস্তকের স্বল্পতা : পুস্তকের বিরলতা রাজনীতিতে এক অন্যতম বাধা হিসেবে দেখা দেয় । যদিও কিছু লেখা প্রকাশিত হতো , তা প্রাচীন লেখার পুনরাবৃত্তি ।
৮. খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য : অধ্যাপক ডানিং বলেছেন , রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে মধ্যযুগের ইতিহাসের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্যের বাইরেও খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠা করা ও গির্জার অগ্রগতি সাধন করা ।
৯. মধ্যযুগের রাষ্ট্রতত্ত্ব : মধ্যযুগের রাষ্ট্রতত্ত্ব ছিল এক ঊষর মরুভূমি । সম্রাট ও পোপের কর্তৃত্ব দ্বন্দ্বের ধূলিঝড়ে অশান্ত । সে সময় রাষ্ট্রচিন্তা ছিল কিন্তু রাষ্ট্রতত্ত্ব ছিল না ।
১০. মুক্তচিন্তার অনুপস্থিতি : মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় মুক্তচিন্তা ছিল না । রাষ্ট্রনীতি ছিল অর্থনীতি , ন্যায়শাস্ত্র ও ধর্মনীতির শৃঙ্খলে আবদ্ধ । রাষ্ট্রনীতি ছিল ন্যায়শাস্ত্রের অনুগত আর ন্যায়শাস্ত্র ছিল ধর্মতন্ত্রের অনুগত ।
১১. স্থবিরতা : মধ্যযুগের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থবিরতা লক্ষ্য করা যায় । মূলত এ কারণেই মধ্যযুগকে অরাজনৈতিক বলে অভিহিত করা হয় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে , সমগ্র মধ্যযুগ ছিল ধর্মীয় বিশ্বাসের যুগ । সেই সময় মানুষের সকল আচরণের মুখ্য নিয়ামক ছিল ধর্ম । যুক্তি থেকে ধর্মীয় বিশ্বাসই ছিল প্রবল । ধর্ম ও রাজনীতি ছিল অভিন্ন সূত্রে গাঁথা । তবে অধিকাংশের মতে এ যুগ অন্ধকার , অরাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোড়ামির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ছিল । মূলত সমগ্র মধ্যযুগ ছিল ধর্মীয় বিশ্বাসের বেড়াজালে আবদ্ধ ।
প্রশ্নঃ মধ্যযুগ ছিল অরাজনৈতিক – এর পক্ষে যুক্তি দেখাও ।
অথবা , মধ্যযুগের প্রেক্ষাপট ছিল অরাজনৈতিক আলোচনা কর । অথবা , মধ্যযুগের রাজনৈতিক অবস্থা ব্যাখ্যা কর ।
উত্তর ৷ ভূমিকা : মধ্যযুগের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে অনেক রাষ্ট্র দার্শনিক এরূপ সিদ্ধান্তে এসেছেন যে , মধ্যযুগ ছিল অরাজনৈতিক । খ্রিস্টীয় ৪০০ সাল থেকে ১৪০০ সাল পর্যন্ত সময়কালকে অনেকে মধ্যযুগ বলে আখ্যায়িত করেন । এ যুগের বৈশিষ্ট্য হলো পোপ ও সম্রাটের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব , সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ এবং রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় ধর্মীয় প্রভাব । স্বাধীনভাবে রাষ্ট্রচিন্তা এ যুগে বিকশিত হয় নি । মূলত ন্যায়শাস্ত্র , ধর্মতত্ত্ব ও অর্থশাস্ত্রের অংশ হিসেবে রাজনীতি আলোচিত হতো । এছাড়া এ যুগে বিশুদ্ধ রাষ্ট্রচিন্তা যেমন নেই তেমনি সর্বজনীন রাষ্ট্রতত্ত্ব গড়ে উঠে নি । এ কারণেই W. A. Dunning মন্তব্য করেছেন , ” The middle age was unpolitical . ” –
মধ্যযুগ অরাজনৈতিক- এর পক্ষে যুক্তি : স্বতন্ত্রভাবে রাজনৈতিক চেতনা ও রাষ্ট্রতত্ত্বের অনুপস্থিতি এবং ধর্মীয় প্রভাবের কারণেই মূলত মধ্যযুগ ছিল অরাজনৈতিক ও অবৈজ্ঞানিক । এ সময় রাষ্ট্রকে ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাবা হতো । Hearnshaw এজন্য বলেছেন , ” The political theory of the middle ages may sometimes appeare like a desert , often disturbed by the sand storm raised by the conflicting genies of papacy and Empire . ” মধ্যযুগ অরাজনৈতিক থাকার বিভিন্ন কারণ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
অনুশাহাত ও ধর্মীয় চেতনার প্রভাব প্রথমদিকে মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা শুধু ধর্মীয় চিন্তাধারার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল । পার্থিব জগৎ ও রাজনৈতিক বিষয়াদির ব্যাপারে এটি কখনো মনোনিবেশ করে নি । রাষ্ট্রতত্ত্ব সংক্রান্ত কোন বিষয় মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার অন্তর্ভুক্ত ছিল না । এ যুগে রাজনীতিকে একটি পৃথক বিষয় হিসেবে মনে করা হয় নি । বস্তুত মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক মতবাদ গির্জা , রোমান সাম্রাজ্য , সামন্তবাদ এবং জাতীয়তাবাদের পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলস্বরূপ । এজন্য অধ্যাপক ডানিং বলেছেন , “ মধ্যযুগ ছিল অরাজনৈতিক ।
২. টিউটন জাতির আক্রমণ মধ্যযুগে রোমান সভ্যতা বিশ্বদরবারে সম্মানের আসন অলংকৃত করতে সমর্থ হয়েছিল । তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষতায় সমগ্র বিশ্ববাসী হয়েছিল অভিভূত ও বিমোহিত এবং রোমানদের দেখিয়েছিল অজস্র সম্মান । কিন্তু বর্বর জার্মান বা টিউটন জাতির আক্রমণে তাদের শৌর্যবীর্য সব নিক্ষেপিত হয় মহাকালের অতল গহ্বরে । ফলে ক্রমান্বয়ে অরাজনৈতিকতা বৃদ্ধি পায় এবং মুক্ত রাজনৈতিক দর্শন সময়ের স্রোতে বিলীন হয়ে যায় ।
৩. স্টোয়িকবাদের প্রভাব মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারাতে স্টোয়িকবাদের যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান ছিল । স্টোয়িকবাদের ন্যায় মধ্যযুগের রাজনৈতিক দর্শন ও প্রাকৃতিক আইন , ঐশ্বরিক শাসন , সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান প্রভৃতি ধারণায় আস্থাবান ছিল , যা অনেকটা অবৈজ্ঞানিক ও অরাজনৈতিক ধারণা । ৪. খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য মধ্যযুগে খ্রিস্টধর্মের এত বেশি প্রাধান্য ছিল যে , কোন মানুষ এর গণ্ডি বহির্ভূত কোন চিন্তার অবকাশ পায় নি । ফলে আবিষ্কার বা উদ্ভাবন বন্ধ হয়ে পড়েছিল । মানুষকে কেবল বাইবেল নির্দেশিত পথে চলতে বাধ্য করা হতো । অধ্যাপক ডানিং তাই বলেছেন , “ রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে মধ্যযুগের ইতিহাসের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্যের বাইরেও খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠা করা এবং গির্জার অগ্রগতি সাধন করা । ” ফলে রাজনীতির ক্ষেত্রে অরাজকতা বা বন্ধ্যাত্বের সৃষ্টি হয় । ৫. গির্জার ক্ষমতা বৃদ্ধি : মধ্যযুগে গির্জার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পোপের ত্রুটিমুক্ত ও পক্ষপাতমুক্ত শাসনব্যবস্থা স্বেচ্ছাচারী শাসককে নিয়ন্ত্রণ করত এবং এক্ষেত্রে কোন বিরোধ ছিল না । ক্রমে গির্জার ক্ষমতার প্রতি জনগণের আসক্তি জন্মে । ফলে গির্জার সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটল । এভাবে গির্জার ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ধর্মযাজকদের রাজনীতিতে বাধ্য করা হলো । গির্জার ক্ষমতা বৃদ্ধি মধ্যযুগে সুষ্ঠু রাজনীতি বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে । ৬. গির্জা ও রাষ্ট্রের মতবিরোধ : গির্জা ও রাষ্ট্রের মতবিরোধই মধ্যযুগের রাষ্ট্রদর্শনে পরিব্যাপ্ত ছিল । একদিকে গির্জার পুরোহিত এবং অন্যদিকে রাষ্ট্রের সম্রাট ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জীবনই নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয়েছিল । ফলে উভয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক কলহ ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় । এ দ্বন্দ্বে গির্জাই জয়ী হয় এবং ক্রমে এর ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় । ফলে সে যুগে অরাজকতা সৃষ্টি হয় । ৭. পোপতন্ত্র : মধ্যযুগের প্রথম পর্বে পোপ তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নতুন টেস্টামেন্ট অপেক্ষা পুরাতন টেস্টামেন্টকে অধিকতর উপযোগী বলে প্রচার করায় পুরোহিততন্ত্র বা যাজকতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় । কেননা পুরাতন টেস্টামেন্টের শিক্ষা অনুযায়ী আইন হচ্ছে খোদার ইচ্ছার অভিব্যক্তি এবং রাজা ও রাজকর্মচারীদের ক্ষমতা সীমিত , পোপের ক্ষমতাই মুখ্য , যা অনেকটা অবৈজ্ঞানিক ও অরাজনৈতিক ব্যাপার বলে গণ্য করা হয় । ৮. রাজনীতি সম্পর্কিত রচনার স্বল্পতা : মধ্যযুগে রাজনীতি সম্পর্কিত মৌলিক কোন রচনা বা পুস্তক ছিল না । দু’একটি রচনা প্রকাশিত হলেও তাতে প্রাচীন যুগের রাষ্ট্রদর্শনের পুনরাবৃত্তি লক্ষণীয় । সেন্ট অগাস্টিন ও সেন্ট টমাস একুইনাসের রাষ্ট্রদর্শন উল্লেখযোগ্য হলেও তা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক । ফলে মধ্যযুগ ছিল অরাজনৈতিক । ৯. দুই তরবারি তত্ত্ব : মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল ‘ দুই তরবারি তত্ত্ব ‘ । অধ্যাপক ডানিং এর মতে , পার্থিব বিষয়ের শাসক ছিলেন রাজা এবং অপার্থিব বিষয়ের শাসক ছিলেন পোপ । এটাই হলো ‘ দুই তরবারি তত্ত্ব ‘ । এ তত্ত্বকে উভয়ের মধ্যকার মীমাংসার উপায় বলে মনে করতেন । কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকরী ছিল না । তাই সমগ্র মধ্যযুগ জুড়ে পোপ ও রাজার সংঘর্ষের কারণে অরাজকতা ও অরাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে , মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো রাজশক্তি ও গির্জার ক্ষমতা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্ব । মধ্যযুগের আরেকটি লক্ষণীয় দিক ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় চিন্তাচেতনার প্রভাব । সবকিছুই চিন্তা করা হতো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে । যুক্তিতর্কের পর্যবেক্ষণের কোন স্থান ছিল না ।