অথবা, ভারতের পরবর্তী রাজনীতিতে লাহোর প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তান সৃষ্টিলগ্নে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক যুগান্তকারী অধ্যায়। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অধিবেশনে মুসলমানদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সতর্ক দৃষ্টি রেখে তদানীন্তন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে
বাংলা এ. কে. ফজলুল হক যে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেন সেটিই ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব নামে পরিচিত। মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য জাতীয়তাবাদী চেতনার মূলমন্ত্র ধর্মের উপর ভিত্তি করে ভারত বিভক্তির মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিই ছিল লাহোর প্রস্তাবের মূলকথা।
ভারতের পরবর্তী রাজনীতিতে এর প্রভাব : লাহোর প্রস্তাব ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম জনসাধারণের মাঝে এক নতুন প্রেরণার সৃষ্টি করে। বলা যায়, লাহোর প্রস্তাবের ফলে ভারতের পরবর্তী রাজনৈতিক
প্রেক্ষাপট পুরাপুরি পাল্টে যায়। আর লাহোর প্রস্তাবের কারণেই ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম লাভ করে, যার বাস্তবায়ন ঘটে ১৯৪৭ সালে। নিচে ধারাবাহিকভাবে লাহোর প্রস্তাবের ফলাফল তুলে ধরা হলো :
১. স্বাধীকার চেতনার উন্মেষ : লাহোর প্রস্তাবের ফলে ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠী স্বাধীকার চেতনায় জাগ্রত হয়ে উঠে এবং স্বতন্ত্র আবাসভূমির আশায় তারা আশান্বিত হয়ে উঠে এবং ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবকে তারা তাদের আন্দোলনের মূল ইস্যু হিসেবে প্রতিপন্ন করে।
২. পৃথক রাষ্ট্র গঠন : লাহোর প্রস্তাবের ফলে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনীতি পৃথক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে পরিণত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুসম্প্রদায় মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে অস্বীকার করে, যা
পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে।
৩. মুসলিম লীগের উন্নয়ন : লাহোর প্রস্তাব মুসলিম লীগকে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দিকনির্দেশনা এনে দেয়। অতি দ্রুত পাকিস্তান আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটে।
৪. ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে : লাহোর প্রস্তাবের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ক্ষেত্রে, যার কারণে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল মুসলিম লীগের অনুকূলে প্রবাহিত হয়। মূলত মুসলিম লীগের পক্ষে এ নির্বাচন ছিল রেফারেন্স তুল্য।
৫. পাকিস্তান পরিকল্পনা : ১৯৪৬ সালে জিন্নাহর নেতৃত্বে ‘দিল্লি মুসলিম লেজিসলেটরস কনভেনশন’ এ মুসলমানদের একাধিক রাষ্ট্র পরিকল্পনাকে বাদ দিয়ে এক পাকিস্তান পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এটা ছিল লাহোর প্রস্তাবের রাষ্ট্র পরিকল্পনায় পরিবর্তনের শামিল।
৬. জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের উন্মেষ : লাহোর প্রস্তাবের ফলশ্রুতিতে জিন্নাহর Two nation’s theory এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। মূলত লাহোর প্রস্তাবের মূল বিষয় ছিল জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের সঠিক প্রতিফলন ঘটানো, যেখানে তাদের ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, মনন, কৃষ্টি, ধর্ম এমনকি অর্থনীতি একক সত্তার পরিণত হয়।
৭. ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য লাভ : লাহোর প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য ছিল ভারত ও পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা এবং তার সার্বভৌমত্ব লাভ করা, যার বাস্তবায়ন ঘটে ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে। ভারত উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল নিয়ে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান এবং বাকি অংশ নিয়ে ভারত ইউনিয়ন।
৮. হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক উন্নয়ন : ব্রিটিশদের ভাগ কর ও শাসন কর (Rule and divide) এর নীতির ফলে হিন্দু-মুসলিম ক্ষেত্রে সর্বদা বিদ্বেষভ
াব বিরাজমান ছিল, যার কারণে ১৯৪৭ সালে দুটি পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি হয় এবং হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটা মাইলফলক হিসেবে কাজ করে। যদিও ১৯৪৭ সালে লাহোর সঠিক বাস্তবায়ন হয়নি।
৯. বাঙালির স্বাধীনতার চেতনা : লাহোর প্রস্তাবের পর বাঙালি অধিকার চেতনায় অনেক বেশি সজাগ হয়ে উঠে। বিশেষকরে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম লাভের পর বাঙালি অধিক সচেতন হয়ে উঠে এবং তারা তাদের স্বাধীকার ও জাতীয়তাবোধ চেতনায় জাগ্রত হয়ে সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়ে।
১০. বাঙালি জাতীয়তাবাদ : লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারত বিভক্ত হলে পূর্বাঞ্চলে যেখানে বর্তমানে বাংলাদেশ সেখানে ঐ সময়ই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা ছিল কিন্তু নতুন পাকিস্তানের লাহোর প্রস্তাবের সঠিক বাস্তবায়ন ঘটেনি। ফলে বাঙালি জনগণ তাদের জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করতে এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেমে পড়ে।
১১. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন : লাহোর প্রস্তাবের প্রত্যক্ষ প্রভাব ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা নীতি ও বাঙালিদের ভাষা আন্দোলনের প্রতি প্রতিক্রিয়া তাদের নগ্ন প্রকাশ ঘটায়, যা বাঙালি জনগণ বাংলাকে তাদের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন শুরু করে এবং আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৫২ সালের
২১ ফেব্রুয়ারি। মূলত ২১ ফেব্রুয়ারির জন্ম হতো না যদি না ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র হতো। এখানে মূলত লাহোর প্রস্তাবের একটা ধারাবাহিক চিত্রের পুনরাবৃত্তি হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ব্রিটিশ ভারতের সাংবিধানিক অগ্রগতি এবং মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক আবাসভূমির দাবি উত্থাপনের ক্ষেত্রে এক অনন্য সাধারণ সাংবিধানিক ঘটনা। এদিক থেকে লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান প্রস্তাব (Pakistan resolution) বললেও খুব বেশি অত্যুক্তি হবে না। আর স্বাধীন ও সার্বভৌম ভারত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে লাহোর প্রস্তাবকে একটা মাইলফলক হিসেবে অভিহিত করা যায়।