ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

অথবা, ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যালোচনা কর।
অথবা, ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের একটি পর্যায় হলো সামন্ততন্ত্র । সামন্ত সমাজ কৃষি সমাজ। এ সমাজব্যবস্থার মূলকথা হলো যে, জমির মালিকানা যুগপৎ ঐশ্বর্যের মাপকাঠি এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির নিয়ামক। ভূমি ব্যবস্থাপনার দ্বারা এ সমাজব্যবস্থার ভিত প্রতিষ্ঠিত বলে একেই সামন্তবাদ বা সামন্ততন্ত্র বলা হয়। কিন্তু
প্রাক ব্রিটিশ ভারতের ভূমি অধিকার ব্যবস্থা এবং ইউরোপের ভূমি অধিকার ব্যবস্থার তুলনা করে অনেকেই ভারতের সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষিতে সামন্তবাদ কথাটি ব্যবহার করতে ইচ্ছুক নয়। মূলত দাসব্যবস্থার পতনের মধ্য দিয়ে সামন্ততন্ত্রের সৃষ্টি হয় । ইউরোপে একাদশ, দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ শতকে সামন্ততন্ত্রের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল।
ভারতীয় সামন্তপ্রথার বৈশিষ্ট্য : ভূমি মালিকানা, ম্যানর, ডিমিন অর্থনীতি, কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা এসবের কারণে ভারতে ইউরোপ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারার সামন্ত ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। নিম্নে ভারতীয় সামন্তপ্রথার
বৈশিষ্ট্যাবলি আলোচনা করা হলো :
১. ব্যক্তিগত মালিকানার অনুপস্থিতি : মার্কস বলেন, “The basic form of all phenomena in the east is to be found in the fact that no private property in land existed.” প্রাচ্যে ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা ছিল না, বরং রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দিষ্ট জমি খাজনা আদায়ের জন্য রাজা বা সম্রাটদের মাঝে বণ্টন করা হতো। কিন্তু রাজা ভূমি দান বা বিক্রি কিছুই করতে পারতেন না। খাজনা আদায়ের জন্য রাজাকে ইজারাদার, ওয়াদাদার ইত্যাদি শ্রেণীর উপর নির্ভর করতে হতো। নাজমুল করিম বলেন, “এ মূল সত্য স্মরণ রাখতে হবে যে, ইউরোপের সামন্তপ্রভু জমির মালিক, কিন্তু ভারতের সামন্তপ্রভুরা জমির মালিক নয়। নীতিগতভাবে এবং বাস্তবিক পক্ষে তারা রাজস্ব ইজারাদার মাত্র।”
২. সামাজিক শ্রেণী : ভারতীয় সামন্তপ্রথায় ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় ভূমিভিত্তিক উঁচুনিচু বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী বা পাশ্চাত্যের ন্যায় কোন অভিজাত শ্রেণী গড়ে উঠে নি। ভারতীয় সামন্ত কাঠামোতে তিনটি শ্রেণীর কথা নাজমুল করিম উল্লেখ করেন। এগুলো হলো :
ক. কৃষক শ্রেণী,
খ. খাজনা আদায়কারী শ্রেণী যারা জমিদার বলে চিহ্নিত,
গ. রাষ্ট্র, রাজা যার প্রতিনিধি।
৩. স্বনির্ভর গ্রাম সম্প্রদায় : ভারতীয় গ্রামগুলো গ্রাম কমিটি দ্বারা পরিচালিত স্বনির্ভর এবং সুসংগঠিত। জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় দ্রব্য তারা নিজেরাই উৎপাদন করত। উৎপাদিত দ্রব্য পণ্যে রূপান্তরিত হয় নি। তাই বাজার ব্যবস্থারও প্রসার ঘটে নি । ভারতীয় সমাজব্যবস্থার অর্থনৈতিক একক হলো গ্রামীণ সম্প্রদায়।
৪. কঠোর বর্ণাশ্রম প্রথা : ভারতীয় গ্রামগুলোর আরেকটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো অপরিবর্তনীয় জাতিবর্ণ প্রথা। বর্ণপ্রথায় স্ব-স্ব বর্ণ অনুযায়ী পেশা নির্ধারিত হতো। পেশা পরিবর্তন করা সম্ভবপর ছিল না বিধায় মুক্তবাজার অর্থনীতি বা বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো সম্ভব হয় নি।
৫. গিল্ডের অনুপস্থিতি : ভারতে কঠোর বর্ণপ্রথা ছিল সেজন্য ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় পেশার পরিবর্তন সম্ভবপর ছিল না। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতির কারণে বণিক শ্রেণীর প্রসার ঘটে নি। পাশ্চাত্যের ন্যায় ভারতে কোন শ্রমিক সংঘের সৃষ্টি হয় নি। তাই ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রসার ঘটে নি। এজন্যই প্রাচ্য সামন্ততন্ত্র পুঁজিবাদের জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
৬. দাসপ্রথা : পাশ্চাত্যের ন্যায় ভারতীয় দাসপ্রথা সংগঠিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে নি। ভারতের অর্থনীতিতে তাই দাসদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। দাসরা উৎপাদন যন্ত্রের হাতিয়ারে পরিণত হয় নি, বরং প্রাচ্যে দাসকে গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হতো। এজন্যই ভারতবর্ষের দাসপ্রথাকে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী Domestic slavery,
nominal slavery ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করে। ভারতীয় সমাজে দাসদের নগণ্য ভূমিকার কারণ হলো বর্ণব্যবস্থা।
৭. রাষ্ট্রভিত্তিক জলসেচ ব্যবস্থা : প্রাচ্যের কৃষি পানি সেচের উপর নির্ভরশীল ছিল। সেচ ব্যবস্থার প্রবর্তন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের উপর। পানি সেচ ব্যবস্থার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকায় জনগণ রাষ্ট্রের কাছে জিম্মি ছিল এবং জমি চাষের জন্য রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো। এসব কারণেই কৃষক ব্যক্তিগত মালিকানা দাবি করতে পারে নি। জলসেচ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে জটিল আমলাতন্ত্রের সৃষ্টি হয়। উইটফোগেল ভারত সমাজব্যবস্থাকে জলনির্ভর সমাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
৮. শহরায়নের অভাব : ভারতে ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রসার ঘটে নি এবং শক্তিশালী কোন ব্যবসায়ী শ্রেণীরও সৃষ্টি হয় নি, বাজার ব্যবস্থার প্রসার ঘটে নি। তাই বাণিজ্যভিত্তিক কোন শহরের সৃষ্টি হয় নি, বরং প্রশাসনিক কর্মস্থল, সামন্ত শাসকদের বাসস্থান, সামরিক ভিত্তি, তীর্থকেন্দ্র, বাণিজ্যকেন্দ্র ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে শহরের উৎপত্তি সীমিত
অর্থে শুরু হয়।
৯. শিল্পে পশ্চাৎপদতা : গ্রামব্যবস্থা ও বর্ণপ্রথাকে ভারতের শিল্পের পশ্চাৎপদতার কারণ হিসেব চিহ্নিত করা যায়। ভারতে কোন শিল্পবিপ্লব ঘটে নি কিন্তু ভারতে ধনকুবেরের অভাব ছিল না। কিন্তু ভারতে সঠিকভাবে কোন সংঘ গড়ে উঠে নি, আবার স্বনির্ভর গ্রাম এবং অপরিবর্তনীয় পেশাগত বর্ণপ্রথা ভারতের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
১০. রাজস্ব ব্যবস্থা : ভারতীয় সামন্ততন্ত্রে রাজা বা সামন্ত শ্রেণী কেউই জমির মালিক নয়, বরং রাজস্বের দাবিদার। প্রাক ব্রিটিশ ভারতের রাজস্ব আদায় পদ্ধতি বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। ফসল দ্বারা রাজস্ব আদানপ্রদান চলত এবং গ্রামীণ সম্প্রদায়ের সাথে সামন্ত শ্রেণীর সম্পর্ক রাজস্ব আদানপ্রদানের। উপর্যুক্ত কারণে শেলভানকর বলেন, “ভারতীয়
সামন্ততন্ত্র ছিল রাজস্বভিত্তিক ও সামরিক; ম্যানরভিত্তিক নয়।”
১১. পুঁজিবাদ বিকাশে ব্যর্থতা : ভারতীয় সামন্ততন্ত্র পুঁজিবাদের জন্ম দিতে পারে নি কিন্তু পাশ্চাত্য সামন্ততন্ত্র পুঁজিবাদের জন্ম দিয়েছিল। এর মূলে রয়েছে ব্যক্তিগত মালিকানায় পুঁজি গঠন সম্ভব হয় নি আবার সীমিত বাজার ব্যবস্থা এবং উৎপাদিত দ্রব্য পণ্যে রূপান্তরিত হয় নি। আবার ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না তাই সামন্তসমাজের জমিদার শ্রেণী, ইজারাদার ইত্যাদি শ্রেণী গ্রামীণ উন্নয়নের কথা ভাবে নি, বরং খাজনা আদায়ে অধিক তৎপর ছিল। বণিক শ্রেণী উদ্ভব না হওয়া, কঠোর বর্ণপ্রথা এসব কারণে ভারতীয় সামন্ততন্ত্র পুঁজিবাদের জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু পাশ্চাত্যে সামন্ততন্ত্রের পতনের মাধ্যমে পুঁজিবাদের উন্মেষ ঘটেছিল
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ভূমি এবং ভূমি ব্যবস্থাকে ভিত্তি করে এক বিশেষ ধরনের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার নাম সামন্ততন্ত্র। ভারতে সামন্ততন্ত্র সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছিল এর ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে । সামন্তপ্রভুরা উৎপাদন বৃদ্ধির অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত বিষয়ে বেশি চিন্তা করত না, ফলে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে নি । ভূমি মালিকানার অনুপস্থিতি, কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ইত্যাদি ভারতীয় সামন্ত কাঠামো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে।