ভারতীয় সমাজে সামন্ততন্ত্রের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছিল?

অথবা, ভারতীয় সমাজে সামন্ততন্ত্রের উৎপত্তি লিখ।
অথবা, ভারতীয় সমাজে সামন্ততন্ত্রের উৎপত্তি বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের একটি পর্যায় হলো সামন্ততন্ত্র। সামন্ত সমাজ কৃষি সমাজ। এ সমাজব্যবস্থার মূলকথা হলো যে, জমির মালিকানা যুগপৎ ঐশ্বর্যের মাপকাঠি এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির নিয়ামক। ভূমি ব্যবস্থাপনার দ্বারা এ সমাজব্যবস্থার ভিত প্রতিষ্ঠিত বলে একেই সামন্তবাদ বা সামন্ততন্ত্র বলা হয়। কিন্তু প্রাক ব্রিটিশ ভারতের ভূমি অধিকার ব্যবস্থা এবং ইউরোপের ভূমি অধিকার ব্যবস্থার তুলনা করে অনেকেই ভারতের সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষিতে সামন্তবাদ কথাটি ব্যবহার করতে ইচ্ছুক নয়।
ভারতীয় সমাজে সামন্ততন্ত্রের উৎপত্তি : সামন্ততন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ Feudalism শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Feud বা Fiet থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ খণ্ড খণ্ড ভূমি। মূলত ভূমি ব্যবস্থাপনার উপর ভিত্তি করে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব। রোমান ও জার্মান এ দু’টি সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে সামন্তপ্রথার উদ্ভব হয়। অনেকে মনে করেন রোমান দাস ব্যবস্থার পতনের মধ্য দিয়েই ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের সূচনা ঘটে, যা নবম শতক থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ক্রীতদাস প্রথা পতনের মধ্য দিয়েই সামন্ততন্ত্রের উৎপত্তি হয়েছিল। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপে সামন্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং প্রাচ্যেও এ ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। কিন্তু প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সামন্ততন্ত্রের ধারা ভিন্ন। ম্যাক্স ওয়েবার বলেন, “অর্থ ও সৈন্য সংগ্রহের আদি রাজনৈতিক ক্ষমতা, বেসরকারি ঠিকাদার, আমলা বা সেনানি এ তিন শ্রেণীর হাতে সমর্পণ প্রাচ্য সামন্ততন্ত্রের ভিত্তি। নিজস্ব আমলার দ্বারা কর আদায়ে রাষ্ট্রের কৌশলগত অপারগতার দরুন মুদ্রা অর্থনীতি ভেঙে পড়ার ফলে এ সামন্ততন্ত্রের বিকাশ ঘটে।” প্রকৃতপক্ষে জলবায়ু, ভূমি ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রকৃতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো প্রভৃতি কারণে ভারতে ইউরোপ থেকে স্বতন্ত্র সামন্ততন্ত্রের পত্তন ঘটে। ভারতীয় সামন্তপ্রথায় ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। সমাজের
শাসনক্ষমতা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের উপর ন্যস্ত ছিল। জটিল আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখানে গড়ে উঠেছিল । সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় এখানে মালিকানার ভিত্তিতে কোন অভিজাত শ্রেণী গড়ে উঠে নি। সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় মালিকানা ছিল তাই তিনি দান বা কেনাবেচা করতে পারতেন না, বরং খাজনা
আদায়ের অধিকার ছিল। তারা নির্দিষ্ট এলাকায় খাজনা আদায়ের অধিকার ছিল তারা মালিক নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করত। ভূমিকে তিন ভাগে ভাগ করা হতো এবং এর ভিত্তিতে খাজনা আদায় চলত। ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় প্রাচ্য সামন্ততন্ত্র পুঁজিবাদের জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ভারতীয় সামন্তপ্রথায় তিনটি শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল- কৃষক শ্রেণী, খাজনা আদায়কারী শ্রেণী এবং রাষ্ট্র রাজা যার প্রতিনিধিকারী। ভারতীয় সামন্তপ্রথায় কোন ম্যানর প্রথা গড়ে উঠে নি এবং মৌলিক ভিত্তি ছিল স্বনির্ভর গ্রাম সম্প্রদায়, বর্ণাশ্রম ইত্যাদি।
উপসংহার : উপরের আলোচনার আলোকে একথা বলা চলে যে, ভূমি এবং ভূমি ব্যবস্থাকে ভিত্তি করে এক বিশেষ ধরনের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার নাম সামন্ততন্ত্র। ভারতের সামন্ততন্ত্র সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল এর ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য। সামন্তপ্রভুরা উৎপাদন বৃদ্ধির প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক বিষয়ে বেশি চিন্তা করত না। তাই তখন পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে নি।