ভারতীয় সমাজের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন সমূহ আলোচনা কর।

অথবা, ভারতীয় সমাজের প্রেক্ষাপটে জাতিবর্ণের পরিবর্তনসমূহ কী কী?
আলোচনা কর।
অথবা, ভারতীয় সমাজের প্রেক্ষাপটে জাতিবর্ণের পরিবর্তনের দিকসমূহ
আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা :
জাতিবর্ণ প্রথার মাধ্যমে সামাজিক অসমতার তথা স্তরবিন্যাসের চিত্র সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। জাতিবর্ণ হলো একটি বন্ধ গোষ্ঠী। যখনই কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে উত্তরাধিকার সূত্রে বিচার করা হয় তখনই তাকে নির্দিষ্ট জাতিবর্ণে অভিহিত করা হয়। বস্তুত জাতিবর্ণ ব্যবস্থা হচ্ছে সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি সুকঠোর ব্যবস্থা। অন্যভাবে বলা যায়, জাতিবর্ণ ব্যবস্থা বলতে জাতিতত্ত্বের সূত্রে আবদ্ধ এমন ব্যাপক গোষ্ঠীসমূহকে বুঝায় যারা ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগের নীতি অনুসারে একটি অনমনীয় সামাজিক স্তরবিন্যাসে সংগঠিত।
জাতিবর্ণ প্রথার পরিবর্তন প্রেক্ষাপটে ভারতীয় সমাজব্যবস্থা : ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় সমাজে জাতিবর্ণ প্রথার ভিত্তিতে আমরা যে সামাজিক চিত্র দেখতে পাই আধুনিক কালে সেখানে তা পূর্বাবস্থায় আর নেই। প্রকৃতপক্ষে, স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় সমাজে নানা কারণে জাতিবর্ণ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
প্রথমত, যেসব রীতিনীতি বা বিধিবিধান জাতিবর্ণ ব্যবস্থার অনুকূলে কাজ করেছিল সেসবের অনেকগুলোরই ব্রিটিশ আমলেই অবসান ঘটে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, Caste court-এর বিচারে যারা আগে শাস্তি পেতো, তারা ব্রিটিশ শাসনামলে স্থাপিত কোর্টে মানহানির অভিযোগে Caste leader দের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারতো।
দ্বিতীয়ত, ভারতীয় সমাজে শিক্ষাবিস্তারের ফলে সকল জাতিবর্ণের মধ্যেই সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে; সাম্য ও গণতন্ত্রের ধ্যানধারণার বিকাশ ঘটেছে। পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক চিন্তা, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, যৌক্তিক দর্শন এবং সর্বোপরি বিজ্ঞান মনষ্কতার কারণে জাতিবর্ণসমূহের মধ্যে পূর্বেকার পারস্পরিক বৈষম্যমূলক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
তৃতীয়ত, সনাতন ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন জাতিবর্ণের মানুষ স্ব-স্ব জন্মগত পেশা অবলম্বন করে মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটিয়ে আসছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার যখন ভারত থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ শুরু করে এবং তাদের যন্ত্র উৎপাদিত দ্রব্য ভারতের বাজার দখল করে, তখন ভারতের দেশজ শিল্পের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন হয়। বর্ণ ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান খুঁটি ছিল অর্থনৈতিক স্থিরতা। পরিবর্তিত অবস্থায় এ খুঁটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। বর্ণ ব্যবস্থা অনুসারে যার যা বৃত্তি ছিল, সে আর তা ধরে রাখতে ভরসা পায় না। ফলে জাতিভেদ অর্থনীতির ক্ষেত্র পরিহার করে শুধু সামাজিক ক্রিয়াকরণে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, নানা কারণে জাতিবর্ণ প্রথা সামাজিক ক্ষেত্রেও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। শহরে তো বটেই গ্রামেও এর লক্ষণ সুস্পষ্ট।
চতুর্থত, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের জাতেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করলো এবং নিজেদের বর্ণ সংস্থা গঠন করলো। ইংরেজ শাসন আমলে ভারতের কোন কোন অঞ্চলে, বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে অব্রাহ্মণ বর্ণগুলো সফলতার সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও শাসনব্যবস্থা সংক্রান্ত কাজে ব্রাহ্মণ বর্ণের মানুষের প্রবেশকে নিয়ন্ত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিল।
পঞ্চমত, নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে আধুনিক সমাজে পেশার ক্ষেত্রে এসেছে বৈচিত্র্য। বিভিন্ন জাতিবর্ণের মানুষ এখন এসব আধুনিক পেশা গ্রহণ করতে এগিয়ে আসছে। এসব পেশায় চাই শিক্ষা ও দক্ষতা। শিক্ষা ও দক্ষতার বলে যে কোন জাতিবর্ণের মানুষই এখন কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে কর্মক্ষেত্রে, হোটেল, রেস্তোরাঁয়, যানবাহনে, পথেঘাটে, সব জাতিবর্ণের মানুষই একে অপরের সাথে মিশছে, যা ঐতিহাসিক জাতিব র্ণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনছে।
ষষ্ঠত, ভারতীয় হিন্দুসমাজ ব্যবস্থায় ১৯৫৫ সালে আন্তর্জাতিবর্ণ ব্যবস্থার ভিতর বিয়ের অনুমতি প্রদান করা হয়। সীমিত পরিসরে হলেও নগর সমাজে এখন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণির একটা অংশ ভিন্ন জাতিবর্ণে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে আগের মতো অনীহা দেখাচ্ছে না। বস্তুত নগর জীবনে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভিতর অন্তর্বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে, যদিও তা প্রায়ই সামাজিক সমালোচনার সম্মুখীন হয়। তাছাড়া ভারতীয় গ্রামীণ সমাজে ভিন্ন জাতিবর্ণে বিবাহ
এখনো খুবই বিরল ঘটনা।
সপ্তমত, ভারতে আধুনিক সমাজে আর্থিক এবং পেশাগত সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় জাতিবর্ণগুলো শ্রেণিতে রূপ নিচ্ছে। এমনকি প্রতিটি জাতিবর্ণের মধ্যেই বিভিন্ন আর্থিক শ্রেণির জন্ম হচ্ছে। ফলে আধুনিক ভারতীয় সমাজ ক্রমশ জাতিবর্ণ নয়, বরং শ্রেণিভিত্তিক সমাজে রূপ নিচ্ছে এবং তা ক্রমশ সমাজ কাঠামোয় পরিবর্তন আনছে। ভারতের বর্তমান
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাতিবর্ণগুলো ক্ষমতা গোষ্ঠীরও রূপ ধারণ করছে। এতে করে সামাজিক স্তরবিন্যাসে শ্রেণি এক বিশেষ
ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সমাজে এখন গতিশীলতাও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে হয়।
অষ্টমত, ভারতবর্ষে সপ্তদশ শতাব্দীতে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীতেও বিভিন্ন সমাজসংস্কারমূলক আন্দোলন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার সনাতন রেওয়াজে কিছুটা পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। রাজা রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর প্রবর্তিত অনেক
সমাজসংস্কারমূলক আন্দোলন ধীরে ধীরে হিন্দুসমাজে অনেক বৈষম্যমূলক প্রথা দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে
আসছে বলে অনেকের ধারণা।
নবমত, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর ১৯৪৯ সালে ভারতে অস্পৃশ্যতাকে বেআইনি বলে ঘোষণা করা হয়। তাছাড়া বিশ্বখ্যাত ভারতীয় নেতা মহাত্মা গান্ধী অস্পৃশ্যদের হরিজন বলে আখ্যা দেন এবং তাদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য সচেষ্ট হন। তাছাড়া পরবর্তীকালে হরিজনরা এখন ভারতীয় আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাদের অধিকার আইন কর্তৃক স্বীকৃত হয়। বর্তমানেও দেখা যায়, ভারতীয় সমাজে আইনের দৃষ্টিতে যে কোন ধরনের অস্পৃশ্যতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সামাজিক অসমতা সৃষ্টিতে জাতিবর্ণ প্রথা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সপ্তদশ শতাব্দী, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতে মারাত্মক জাতিবর্ণ প্রথা প্রবর্তিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন সমাজসংস্কারকদের আগমনের ফলে ইংরেজদের শাসন, উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসায় বাণিজ্যের উন্নতি
প্রভৃতির ফলে জাতিবর্ণ প্রথা বিলুপ্ত হতে থাকে। এ সম্পর্কে Hutton বলেছেন, “নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিক কালে Caste system পরিবর্তন ঘটেছে। সামাজিক প্রথার রদবদল অবশ্যই ঘটেছে।” তারপরও কিছু কিছু সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, ভারতের গ্রামীণ সমাজে এত পরিবর্তন সত্ত্বেও জাতপ্রথার বহুবিধ বিষয় এখনো প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ হয়ে রয়েছে। আজও দেশের অনেক অংশে তফসিলি জাতির মানুষদের মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ রয়েছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b7%e0%a6%b7%e0%a7%8d%e0%a6%a0-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4/