ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো কী কী? আলোচনা কর।

অথবা, ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে আনীত আপত্তিগুলো ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে আনীত আপত্তিগুলো কী কী? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ জ্ঞানের অন্বেষণ করে চলে। মানুষের এ জানার আগ্রহ চিরন্তন। মানুষ জানতে চায় বিচিত্র জগৎ ও জীবন সম্পর্কে। জানার এ আকাঙ্ক্ষা থেকেই সুদূর অতীতে জন্ম নিয়েছিল দর্শন। দার্শনিক থেলিস থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন মনীষীর শাণিত চিন্তাধারায় পরিপূর্ণ হয়ে দর্শন আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। ভারতীয় দর্শনও এর ব্যতিক্রম নয়। এর রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস ও বিকাশধারা। রয়েছে তার
নিজস্ব প্রকৃতি ও পরিধি, যা ভারতীয় দর্শনকে দিয়েছে এক স্বতন্ত্র চরিত্র।
ভারতীয় দর্শন : ভারতীয় দর্শন হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের জীবন ও জগৎ থেকে উদ্ভূত কতকগুলো মৌলিক সমস্যা ও তার যৌক্তিক অনুসন্ধান। এককথায়, ভারতীয় দর্শন হচ্ছে এ উপমহাদেশের জীবন ও জগৎকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঋষি-যোগীর কাছে যে মৌলিক প্রশ্ন উঠেছে এর যৌক্তিক অনুসন্ধান।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : নিম্নে ভারতীয় দর্শনের কয়েকটি সংজ্ঞা দেয়া হলো : দার্শনিক অর্জুন বিকাশ চৌধুরী তাঁর ‘ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন যে, “প্রাচীন যুগ থেকে অদ্যাবধি ভারতবর্ষের হিন্দু, অহিন্দু, আস্তিক, নাস্তিক সর্বশ্রেণীর চিন্তাবিদদের বিভিন্ন দার্শনিক সমস্যা সম্পর্কে সমস্ত মতবাদ ভারতীয় দর্শন। ভারতীয় দর্শন বলতে ভারতবর্ষের সমগ্র তত্ত্বচিন্তাকেই বুঝায়।” আবার দার্শনিক জগদীশ্বর তাঁর ‘ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থের তৃতীয় ও চতুর্থ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “ভারতীয় দর্শন কথাটির অর্থ সবার কাছে সুস্পষ্ট নয়। কারণ এ কথাটির দুটি অর্থ হতে পারে। ১. ভারতীয় ভৌগোলিক সীমারেখার অধীনে চিন্তাবিদগণের বিশ্ব ব্যবস্থা সম্বন্ধীয় যাবতীয় সমস্যাবলির প্রেক্ষিতে সুচিহ্নিত অভিমতকে বুঝাতে পারে। ২. ভারতীয় ভৌগোলিক সীমারেখার অন্তর্ভুক্ত চিন্তাবিদগণের দ্বারা জগৎ জীবন সম্বন্ধীয় চিহ্নিত সমস্যাবলির প্রেক্ষিতে সুচিন্তিত মতামতকে ভারতীয় দর্শন বুঝাতে পারে।”
ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ : নিম্নে ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে আনীত প্রভিযোগগুলো আলোচনা করা হলো :
১. ভারতীয় দর্শন নির্বিচারবাদী দর্শন : এ অভিযোগ ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে অনেকেই করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো নির্বিচার দর্শন বলতে কি বুঝায়? যে দর্শন স্বাধীন চিন্তা ও বিচারবুদ্ধির সাহায্য না নিয়ে অর্থাৎ বিনা বিচারে কোন নীতিকে স্বতঃসিদ্ধরূপে গ্রহণ করে দার্শনিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে তাকে নির্বিচারবাদী দর্শন বলা হয়। ভারতীয় দর্শনকে যারা নির্বিচারবাদী বলেছেন তাদের যুক্তি হলো, ভারতীয় দার্শনিকরা বেদের প্রাধান্য স্বীকার করেন এবং বেদকে অভ্রান্ত বলে মনে করেন। স্বাধীন চিন্তা ও বিচারবুদ্ধির উপর তাদের দর্শন প্রতিষ্ঠিত নয়। ভারতীয় দার্শনিকরা মনে করেন, বেদকে ব্যাখ্যা করা, বেদবাক্য বিনা বিচারে গ্রহণ ও প্রচার করা দর্শনের একমাত্র কাজ। অভিযোগকারীরা কেবল যে আস্তিক দর্শনের
বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেছেন তা নয়, তারা নাস্তিক দর্শনের বিরুদ্ধেও এ অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তারা বলেছেন, নাস্তিক দর্শনেও বিনা বিচারে মহাপুরুষ এবং ধর্মপ্রবর্তকদের বাণীকে অভ্রান্ত বলে মনে করেন। যেমন- বৌদ্ধ ও জৈন দার্শনিকেরা যথাক্রমে গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীরের বাণীকে বিনা বিচারে অভ্রান্ত বলে গ্রহণ করেন।
২. ভারতীয় দর্শন দুঃখবাদী : কোন কোন দার্শনিক বিশেষ করে পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ ভারতীয় দর্শনকে দুঃখবাদী দর্শন বলেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দুঃখবাদ বলতে কি বুঝায়? যে মতবাদ অনুসারে জগৎ এবং জীবন দুঃখ ও নৈরাশ্যে পূর্ণ বা জগৎ জীবনে কোন সুখ ও আনন্দের আশা নেই সে মতবাদকে দুঃখবাদ বলা হয়। প্রকৃত দুঃখবাদ অনুসারে দুঃখই
জীবনের আদি, মধ্য ও অন্ত। ভারতীয় দর্শন দুঃখবাদী এবং ব্যবহারিক জীবনে অনিষ্টকর এ অভিযোগ ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে যারা উপস্থাপন করেছে তারা বলেছেন, ভারতীয় দার্শনিকেরা তাদের দর্শনে জগৎ ও জীবনের কেবল অন্ধকারময় রূপটিকে অঙ্কিত করেছে। অভিযোগকারীরা বলেছেন, ভারতীয় দার্শনিকদের মতে, মানুষ ব্যাধি, জরা ও মৃত্যুর অধীন; জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ কেবল জ্বালা যন্ত্রণা, দুঃখ ও নৈরাশ্যের বেদনায় অস্থির; জগৎ ও জীবনে এক বিন্দু সুখের আশাও নেই। তাই অভিযোগকারীর মতে, ভারতীয় দর্শন চরম দুঃখবাদী।
৩. ভারতীয় দর্শন কেবল নীতি ও ধর্মে সীমাবদ্ধ : কোন কোন দার্শনিক বিশেষ করে পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ ভারতীয় দর্শনকে নীতি ও ধর্মশাস্ত্র বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মতে, ভারতীয় দর্শনের আলোচনা নীতি ও ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং ভারতীয় দর্শনে জগৎ সম্বন্ধে কোন আলোচনা নেই। তাঁদের মতে, ভারতীয় দর্শনে জগৎকে জানার এবং বুঝার চেষ্টা করা হয় নি, তাই এরূপ দর্শনকে সত্যিকারের দর্শন বলা যায় না এবং দর্শনের ইতিহাসে এর স্থান হওয়া উচিত নয়। অভিযোগকারীরা আরো বলেছেন, ভারতীয় দর্শন জীবন দর্শন। জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা হতে ভারতীয় দর্শনের উৎপত্তি। জীবনের লক্ষ্য কি? কিভাবে এ লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়? জাগতিক দুঃখদুর্দশার কারণ কি? এ দুঃখ হতে মুক্তিলাভের উপায় কি? ধর্ম কি? অধর্ম বলতে কি বুঝায়? অধর্মের ফলাফল কি? ঈশ্বর কে? ব্রহ্ম কে? ইত্যাদি সকল নীতি ও ধর্ম সম্পর্কীয় প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন ভারতীয় দার্শনিকেরা। তাই ভারতীয় দর্শন জীবন দর্শন, জগদ্দর্শন নয় এবং দর্শনের ইতিহাসে ভারতীয় দর্শন স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়।
৪. ভারতীয় দর্শন নীতি বিমুখতার দর্শন : কোন কোন পাশ্চাত্য দার্শনিকের মতে, ভারতীয় দর্শন নীতি বিমুখতার দর্শন। কারণ ভারতীয় দার্শনিকগণ নৈতিক কর্মসম্পাদনের উপর কোন রকমের গুরুত্বারোপ করেন নি। তারা অভিযোগ করেন, ভারতীয় দর্শন মুক্তির দর্শন বলে তার প্রভাবে ভারতীয়গণ নৈতিক কর্মে উদাসীন ছিলেন। ফলে জগৎ ও জীবনের
প্রতি নৈতিক ও সমাজহিতকর কর্মের প্রতি তারা উদাসীন হন। তাই অভিযোগকারীরা বলেছেন, ভারতীয় দর্শন নীতি এবং জগৎ বিমুখ।
৫. ভারতীয় দর্শন গতিহীন বা নিশ্চল : ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ হলো ভারতীয় দর্শন গতিহীন বা নিশ্চল। এখানে একই বিষয়ের গতানুগতিক আলোচনা হয়। চিন্তার ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি নেই। অভিযোগকারীরা বলেছেন, ভারতীয় দার্শনিকেরা অতীত ও প্রাচীনের প্রতি বেশি শ্রদ্ধাশীল। সে কারণে পুরাতন বিষয়গুলোকে তারা আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ভারতীয় দর্শনের প্রকৃতি জ্ঞানবাদী, ব্যবহারিক, অন্তর্মুখী, ভারতীয় দর্শনের এ প্রকৃতি তাকে অন্যান্য দর্শন থেকে পৃথক করে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। ভারতীয় দার্শনিকগণ শুধু জ্ঞানের পিপাসা নিবারণের জন্য দর্শন চর্চা করেন নি, বরং মানুষের ব্যবহারিক জীবনের চাহিদা পূরণ, আত্মার মুক্তি, আধ্যাত্মিক প্রশান্তি সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটন, জগতের স্বরূপ উপলব্দি, ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ সর্বোপরি মানবকল্যাণ সাধন ছিল তাদের উদ্দেশ্য। যা এর প্রকৃতির মধ্যে ফুটে উঠে। আর এ কারণেই ভারতীয় দর্শন তার নিজস্ব চরিত্রে উজ্জ্বল হয়ে আছে।