অথবা, ভারতীয় উপমহাদেশে পুঁজিবাদের ব্যর্থতার কারণ কী?
উত্তর৷ ভূমিকা : সামন্তবাদের পতনের মধ্য দিয়ে ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। পৃথিবীর সর্বত্র পুঁজিবাদ বিকাশের স্বরূপ একই ছিল না। ইউরোপে শিল্প প্রসারের ফলে পুঁজিবাদ দ্রুতগতিতে বিকাশলাভ করে। ভারতীয় উপমহাদেশে পুঁজিবাদ বিকাশের অনুকূল পরিবেশ ছিল না। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে ইউরোপের ন্যায় পুঁজিবাদ বিকশিত হয় নি।
ভারতীয় উপমহাদেশে পুঁজিবাদ ব্যর্থ হওয়ার কারণ : ভারতীয় উপমহাদেশে পুঁজিবাদ বিকাশের পিছনে কতকগুলো প্রতিবন্ধকতা ছিল। এগুলো নিম্নরূপ :
১. স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সম্প্রদায় : ভারতীয় উপমহাদেশে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সম্প্রদায় ছিল। গ্রাম সম্প্রদায় ছিল স্বাধীন। তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্য উৎপাদন করত। সমাজ চিন্তাবিদগণ এ গ্রাম সম্প্রদায়কে একেকটি ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ গ্রাম সম্প্রদায়গুলোতে কোন পরিবর্তন সূচিত হয় নি।
২. বর্ণপ্রথা : ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যতিক্রমী বর্ণপ্রথার উদ্ভব ঘটে, যা পৃথিবীর কোথাও ছিল না। বর্ণপ্রথায় চারটি বর্ণের উপস্থিতি ছিল। হিন্দুধর্মের অনুসারীরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র- এ চারটি প্রধান বর্ণে বিভক্ত ছিল। বর্ণপ্রথা ছিল কঠোর, মানুষ যে বর্ণে জন্মগ্রহণ করত সে বর্ণ আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকত। বর্ণ পরিবর্তনের কোন সুযোগ ছিল না। ফলে
বর্ণপ্রথা কোন পরিবর্তনকে সমর্থন করতে পারে নি। |
৩. ভারতীয় সামন্তবাদের প্রকৃতি : ইউরোপের সমসাময়িককালে ভারতীয় উপমহাদেশে সামন্তবাদের বিকাশ ঘটলেও ভারতীয় সামন্তবাদ ইউরোপীয় সামন্তবাদ থেকে ভিন্ন প্রকৃতির ছিল। ভারতীয় সামন্তবাদে ভূমি ও ভূমিদাসদের উপর সামন্ত প্রভুদের মালিকানা ছিল না। ভারতীয় সমাজে সামন্তপ্রভুরা ইচ্ছামতো শার্সন পরিচালনা করতে পারত না। সামন্তপ্রভুরা শুধু নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আদায় করত।
৪. যোগাযোগ ব্যবস্থা : উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। ভারতীয় উপমহাদেশে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠে নি। স্থলপথের প্রধান বাহন ছিল গরুচালিত গাড়ি এবং জলপথে পালচালিত নৌকা। আধুনিক কোন যানবাহন সেখানে ছিল না।
৫. ধর্মীয় মনোভাব : ভারতীয় উপমহাদেশের সকল ধর্মে মধ্যযুগে কুসংস্কার, গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাস প্রভৃতি স্থান করে নিয়েছিল । ব্যবসায় বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সমাজ সমর্থন করে নি।
৬. অধিক জনসংখ্যা : অধিক জনসংখ্যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে কোন দেশের বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ভারতীয় উপমহাদেশে জনসংখ্যাধিক্য পুঁজিবাদ বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল ।
৭. ভোগবিলাসিতা : ভারতীয় উপমহাদেশে সকল শ্রেণীর মানুষ অত্যধিক ভোগবিলাসিতায় মত্ত থাকত। তারা অর্থনৈতিক কোন উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগ না করে ভোগবিলাসিতায় ব্যয় করত, যা পুঁজি গঠনের জন্য প্রতিকূল ছিল।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশে ইউরোপের ন্যায় পুঁজিবাদ বিকাশলাভ করে নি। এ উপমহাদেশের আর্থসামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক অবস্থা পুঁজিবাদ বিকাশের জন্য অনুকূল এবং প্রশস্ত পথ সৃষ্টি করতে পারে নি।