উত্তর : ভূমিকা :চতুর্থ শতাব্দীতে রামানন্দ এলাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সর্ব প্রথম জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। তার ১২ জন শিষ্যের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ছিলেন কবির। তিনি অকুতভয়ে হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মের উপর প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি শাস্ত্র ও পণ্ডিতকে এবং কোরান ও মোল্লাকে তুল্যরূপ তিরস্কার করেছিলেন। তিনি জনসাধারণের মাঝে তার নিজস্ব ভাষায় বাণী দান করতেন এবং তার দোয়ার মাধ্যমে ভক্তের মূলকথা প্রচার করতেন।
→ ভক্তিবাদ আন্দোলন : ভারতে ইসলাম ধর্ম প্রসারের ফলে হিন্দু ধর্ম ও সমাজে অস্থিরতা দেখা যায়। হিন্দুরা অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশই ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলমান। এই ধর্মান্তরিত প্রক্রিয়া হয়তো হিন্দুদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে নি, কিন্তু এই প্রক্রিয়া হিন্দুদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আত্মরক্ষা ও সমালোচনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হিন্দু ধর্ম ও সমাজের কুপ্রথা ও রীতিনীতি তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। অন্যদিকে, ইসলামের গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভ্রাতৃত্ববোধ
হিন্দুদের গভীর ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। ফলে হিন্দুদের মধ্যে এক উদারনৈতিক ধর্ম আন্দোলনের সূত্রাপাত হয়। বিভিন্ন ধর্ম
প্রচারক জনগণের মধ্যে প্রেম, মৈত্রী, ভালোবাসা ও ভক্তির বাণী প্রচার করতে থাকেন। এই ধর্ম আন্দোলনই ভক্তিবাদ নামে
পরিচিতি। এইসব ধর্ম প্রচারক প্রচার করেন যে, সমস্ত ধর্মই.সমান ও ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তারা মনে করেন যে, বিভিন্ন
| প্রথা সর্বস্ব আচার অনুষ্ঠানের পরিবর্তে জীবে প্রেম ও ঈশ্বরের প্রতি অখণ্ড ভক্তি ও শ্রদ্ধাই একমাত্র মুক্তির পথ।
→ ভক্তিবাদের লক্ষ্য ও আদর্শ : ভক্তিবাদের মূল কথা হলো | ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তির মিলন ও আধ্যাত্মবাদ। মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যেও ঈশ্বর বা বুদ্ধ আরাধনার আদর্শ উচ্চারিত হয়েছে। গুপ্ত যুগে রামায়ণ ও মহাারত নতুন করে রচিত হওয়ায় তখন জ্ঞান ও কর্মের সঙ্গে ভক্তিবেত্ত আত্মার মুক্তির পথ হিসেবে । স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে দাক্ষিণাত্যে ভক্তিবাদের পূর্ণবিকাশ ঘটেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল যে, ঈশ্বর ভক্তিই মুক্তির পথ। জাতিভেদ প্রথার
কঠোরতা দূর করে ঈশ্বরের ভক্তি ও শ্রদ্ধার উপর জোড় দেওয়া হয়েছিল। কাজেই ভক্তিবাদের আদর্শ সুলতানি সাম্রাজ্যের
অভুত্থানের আগেই প্রচলিত ছিল। তবে ইসলামের সংস্পর্শে আসার ফলে ভক্তিবাদ এক নতুন মাত্রা পায়। চতুদর্শ ও পঞ্চদশ
শতকে ভক্তিবাদের প্রসার তার সাক্ষ্য দেয়।. ইসলামের মানবতা বাদ, সুফি মতাদর্শ ও ভ্রাতৃত্ববোধ হিন্দুদের গভীর ভাবে প্রভাবিত
করেছিল। বিভিন্ন ধর্ম প্রচারক এই সময়ে ভক্তিবাদের আদর্শ ছড়িয়ে দিয়েছিল ।
→ ভক্তি আন্দোলনের গুরুত্ব ও প্রভাব :
১. ভক্তিবাদের প্রবক্তারা উঠে এসেছিলেন সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন কারিগরি সম্প্রদায়ের
মানুষ অথবা মাঝারি শ্রেণির কৃষক পরিবারের সন্তান। কোনো কোনো ব্রাহ্মণ ভক্তিবাদের দ্বারা প্রভাবিত হলেও সাধারণভাবে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষই এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
২. ভক্তিবাদ হিন্দু ও মুসলমান জনগণকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকে মনে করেন যে, এর
প্রভাব ছির সমাজের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। হিন্দু- মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই যথেষ্ট গোঁড়ামি ছিল। এর ফলে জাতিভেদ প্রথার কোনো বড় রকমের ফাটল দেখা দেয়নি। কালক্রমে কবিরের অনুগামীরা কবিরপন্থি নামে এক স্বতন্ত্র সম্প্রদায় পরিণত হয়। নানকের আদর্শ শিখ ধর্মের জন্ম দেয়।
কাজেই ভক্তিবাদের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করতেই হবে। ভক্তিবাদ
৩. কিন্তু এর সাথে এটাও স্বীকার রকতে হবে যে, সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ
হয়নি। এর প্রবক্তাগণ যে মানবতাবোধ ও ধর্মীয়. চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন, তা হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের গোঁড়ামির উপর এক বড় আঘাত হেনেছিল । পরবর্তী কয়েক শতকেও এর প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্ম সংস্কারক যেসব আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে
তার মধ্যে ভক্তিবাদ আন্দোলন একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। এই আন্দোলনের প্রবক্তা ছিলেন কবির। তিনি হিন্দু ও মুসলমান’
উভয়ের মধ্যে স্বমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে গেছেন। সর্বোপরি, হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে ভক্তিবাদ আন্দোলন একটি
গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন বলে পরিচিত হয়ে আসছে।