অথবা, ব্রিটেনের রাজতন্ত্র আজও টিকে আছে কেন?
অথবা, কিভাবে ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকে?
উত্তরঃ ভূমিকা: ১৯৫১ সালে মিশরের রাজা ফারুক বলেছিলেন, “এখন মাত্র পাঁচজন রাজা অবশিষ্ট আছেন- ইংল্যান্ডের রাজা, রুহিতন (Diamonds), হরতন (Hearts), ইশকাবন (Spade) এবং চিড়িতন (Clubs) এর রাজা।” বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক চেতনা ও আদর্শের ব্যাপক বিস্তারের ফলে শাসনব্যবস্থা হিসেবে রাজতন্ত্রের অবসান অনিবার্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিশ্বের এ প্রাচীনতম সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজতন্ত্র এখনও টিকে আছে।
রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ: গ্রেট ব্রিটেনকে গণতন্ত্রের জন্মভূমি হিসেবে অভিহিত করা হলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এখানে রাজতন্ত্র টিকে আছে। শুধু টিকে আছে বললে এ ব্যবস্থার যথার্থ মূল্যায়ন করা হবে না, বরং রাজশক্তির অস্তিত্বের সাথে রাজনৈতিক ব্যবস্থা এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে রাজতন্ত্র উচ্ছেদের সাথে সাথে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হবে বলে মনে করা হয়, সুতরাং এ ব্যবস্থা উচ্ছেদের নয়। তবে কোন একক কারণে এ ব্যবস্থা টিকে নেই বরং এ ব্যবস্থা টিকে থাকার পশ্চাতে বহুবিধ কারণ বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে বেজহট (Bagehot) বলেন, “Sentiment is not only thing that keeps monarchy in the saddle.”
নিম্নে ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ ও দৃষ্টান্ত আলোচনা করা হল: অধ্যাপক আইভর জেনিংস এর মতে, তাঁর ‘The Queens Government’ গ্রন্থে ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার চারটি কারণ নির্দেশ করেছেন। যথা:
১. রাজা বা রাণী সংবিধানের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে।
২. তাঁকে কেন্দ্র করে কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে ঐক্য বজায় আছে;
৩. তিনি ব্যক্তিগতভাবে কতকগুলো রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন এবং
৪. রাজনৈতিক ক্ষেত্রের বাইরেও রাণীর স্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
ওয়াল্টার বেজহট (Walter Bagehot) এর মতে, রাজতন্ত্র টিকে থাকার পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছেন। যথা:
১. রাজতন্ত্র বোধগম্য শাসনব্যবস্থা:
২. বাজতন্ত্র ধর্মীয় শক্তির বলে কাজ করে:
৩. রাজার অবর্তমানে ৪-৫ বছর পর পর প্রধানমন্ত্রীর পদ পরিবর্তন নিয়ে সমস্যা ঘটত:
৪. ব্রিটিশ জনগণ রাজ প্রতিষ্ঠানকে তাদের নৈতিক জীবনের প্রধান ভূমিকা হিসেবে গণ্য করে এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের আবরণের ফলে ব্রিটেনের প্রকৃত শাসকদের পরিবর্তন করা যায়।
৫. এছাড়াও ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার পিছনে যেসব গতানুগতিক যুক্তির অবতারণা করা হয় সেগুলো হচ্ছে:
১. ইংরেজ জাতির রক্ষণশীল চরিত্র: ইংরেজ জাতি প্রকৃতিগতভাবে রক্ষণশীল মনোবৃত্তি সম্পন্ন হওয়ার জন্য সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্য সমন্বিত এ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে তারা সহজেই বিনষ্ট করতে চান না। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে অধ্যাপক বার্কার বলেছেন, “রাজতন্ত্রের গতি আমাদের ঐতিহ্যপূর্ণ জাতীয় জীবনের নিরবচ্ছিন্নতা মনে করিয়ে দেয়।” তাই ১৯৫৭ সালে লর্ড আলট্রিনচান রাজতন্ত্রের বিলোপসাধনের প্রস্তাব করলে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠে।
২. গণতন্ত্রের বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক নয়: বার্কার এর মতে, “The monarchy has survived because it has changed and because it has moved with the movement of time” বুর্জোয়া শ্রেণী বিভিন্ন প্রকার সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্প্রসারণে আত্মনিয়োগ করলে ব্রিটিশ রাজশক্তি তাদের সে কাজে যথেষ্ট পরিমাণ সহায়তা করেছিল। এ প্রসঙ্গে Ogg and Zink বলেছেন, “ব্রিটিশ রাজশক্তি ব্রিটেনের সরকারি ব্যবস্থায় প্রগতিশীল বিকাশের পথে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি।” তাই এরূপ প্রতিষ্ঠানের বিলোপসাধনে কেউ কোন দিন আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে নি।
৩. রাজনীতি নিরপেক্ষ: রাজশক্তি যদি রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়ত তাহলে অনেক আগেই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী পার্লামেন্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তার বিলোপসাধন করত। কিন্তু রাজা বা রাণী সবসময় রাজনৈতিক দলাদলির উর্ধ্বে অবস্থান করেন বলে তারা সব রাজনৈতিক দল কিংবা সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে আজও অতি আপনজন বলে বিবেচিত হয়।
৪. দেশপ্রেম আপরিত করে আপামর জনসাধারণ রাজা বা রাণীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং তাঁর প্রতি অখণ্ড আনুগত্য প্রদর্শন করে। এ আনুগত্য প্রদর্শন দেশপ্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ। এজন্য অধ্যাপক জেনিংস “রাজতন্ত্রকে দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক বলে বর্ণনা করেছেন।”
৫. বৈদেশিক নীতিনির্ধারণ: বৈদেশিক নীতিনির্ধারণে রাজা বা রাণী অত্যন্ত শান্তভাবে উপদেশ, সতর্ক ও উৎসাহী করে তোলেন। এ নীতিগুলো অত্যন্ত অভিজ্ঞতার আলোকে নির্ধারণ করে দেয়া হয় বলে অভ্যন্তরীণ শাসনকার্য অপেক্ষাকৃত বেশি মূল্যবান করা হয়।
৬. সংসদীয় ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য: ব্রিটেনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে রাজতন্ত্রের উপস্থিতি অপরিহার্য হবে পড়েছে। কারণ সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতি। রাজশক্তির বিলোপসাধন করা হলে শাসনকার্যে নিরবচ্ছিন্নতা দূর করার জন্য ভারতের মত একজন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের পদ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু ঐসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ রাজনীতি নিরপেক্ষ নন বলে শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক সময় নানারকম সমস্যা সৃষ্টি হয়। কিন্তু রাজা বা রাণী রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে কাজ করেন বলে শাসনকার্য পরিচালনায় কোম
রকম সমস্যা সৃষ্টি হয় না। এজন্য ব্রিটেনের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্রের বিকল্পের কথা ভাবা হয় না।
৭. ব্যয়বহুল নয়: অনেকের মতে, ব্রিটেনে রাজপদ বংশানুক্রমিক বলে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের নির্বাচনে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়িত হয় এখানে তা হয় না। রাজতন্ত্রের পিছনে ব্যয় রাজস্বের শতকরা এক ভাগ মাত্র। দেশের শাসনব্যবস্থায় রাজপদের উপযোগিতার তুলনায় এ ব্যয় ইংরেজদের কাছে যৎসামান্য।
৮. রাজা বা রাণীর ব্যক্তিগত ভূমিকা: কোন কোন রাজা বা রাণীর ব্যক্তিগত চরিত্রের মাধুর্য, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সীমাহীন দূরদর্শিতা যুক্তরাজ্যের জনগণের কাছে রাজশক্তিকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। উদাহরণ হিসেবে, হ্যানোভার বংশের রাণী ভিক্টোরিয়া (১৮৩৭-১৯০১) কিংবা উইন্ডজোর বংশের রাজা পঞ্চম জর্জের (১৯১০-১৯৩৬) কথা উল্লেখ করা যায়।
৯. জাতীয় ঐক্যের প্রতীক: জনসাধারণের কাছে রাজপদ হল ঐক্যের প্রতীক, ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক, সর্বজনীন প্রতিনিধি এবং ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল। রাজা কোন বিশেষ দল বা শ্রেণীর প্রতিনিধি নন, তিনি জাতির প্রধান। ‘সর্বসাধারণের রাজা বা রাণী’ এ অনুভূতি ইংরেজদের মধ্যে দেশপ্রেমের সৃষ্টি করে। Jennings বলেছেন, “A monarchy provides a useful focus of patriotism, particularly where it has a long and glorioüs history.”
১০. কেবিনেটকে পরামর্শদান: মন্ত্রীদের মত রাজা বা রাণীর কার্যকালের মেয়াদ রাজনৈতিক উত্থানপতনের উপর নির্ভর করে না। সুদীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাজা বা রাণী কোন জটিল বিষয়ে কেবিনেটকে পরামর্শ দেন। সাধারণত কেবিনেটও তাকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। এছাড়া বিশেষ কোন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য কেবিনেট রাজাকে পরামর্শদানের জন্য অনুরোধ করতে পারে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বর্তমানে ব্রিটেনের রাজতন্ত্র সকল শ্রেণীর মানুষের অনুমোদন লাভ করেছে। আপাত অসামঞ্জস্য সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ রাজতন্ত্রকে প্রাকৃতিক আবহাওয়ার মত স্বীকৃত সত্য হিসেবে মেনে নিয়েছে। তাছাড়া এটি গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক নয়। Prof. Jennings বলেছেন, “রাজতন্ত্র হল ব্রিটিশ সংবিধানের বন্ধন গ্রন্থিস্বরূপ। বর্তমানে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র রাষ্ট্রশক্তির কর্ণধার নয়, কিন্তু অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অঙ্গ।” সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সমাজব্যবস্থার প্রয়োজনেই ব্রিটেনের রাজতন্ত্র কায়েম হয়েছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও হয়ত কখনও এর বিলুপ্তি ঘটবে না।