ব্রিটেনে কেবিনেটের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার কারণ আলোচনা কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, ‘ব্রিটেনে কেবিনেটের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার কারণসমূহ উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার একটি বহুল আলোচিত বিষয় হল কেবিনেটের একনায়কত্ব। অথচ উনবিংশ শতাব্দীতে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বই ছিল ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। মোলবোর্ন, পিল, গ্লাডস্টোন, ডিসরেলির আমলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বিশেষত কমন্সসভা বিপুল ক্ষমতার অধিকারী ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে পার্লামেন্টের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং কেবিনেটের ক্ষমতা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, ভবিষ্যতে কেবিনেটের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। মূলত পার্লামেন্টের চেয়ে কেবিনেটের এ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়াকেই কেবিনেটের একনায়কত্ব বলে অভিহিত করা হয়। ব্রিটেনে কেবিনেটের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার কারণ নিয়ে কেবিনেটের একানায়কত্ব প্রতিষ্ঠার কারণগুলো আলোচনা করা হল:

ক. অভ্যন্তরীণ কারণ এবং
খ. বাহ্যিক কারণ।

ক. অভ্যন্তরীণ কারণ: নিম্নে অভ্যন্তরীণ কারণসমূহ আলোচনা করা হল:

১. জনমতের প্রাধান্য: নানা কারণে জনমতের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা বৃদ্ধি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিভিন্ন প্রকার প্রচারমাধ্যম যেমন- সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে জনমত সংগঠন করা হয়। ফলে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমস্যাবলি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ হয় ঘনিষ্ঠতর। আর এর ফলে কেবিনেটের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়।

২. দলীয় ব্যবস্থার উত্তর: পার্লামেন্টের গুরুত্ব হ্রাসের অন্যতম কারণ দলীয় ব্যবস্থার উদ্ভব। ব্রিটেনে সাধারণ নির্বাচনের পর যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সে দলের নেতারাই কেবিনেট গঠন করে। কেবিনেট কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে। শাসন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত দলীয় নেতাদের নির্দেশ ও সিদ্ধান্তকে কমন্সসভার দলের সাধারণ সদস্যরা অগ্রাহ্য করতে পারেন না, কারণ দল তাদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নিতে পারে।

৩. দলীয় শৃঙ্খলা বৃদ্ধি: প্রত্যেক দলের সদস্যগণই দলীয় শৃঙ্খলার দ্বারা আবদ্ধ। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সদস্যদের প্রতি দল কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, এমনকি বহিষ্কারও করতে পারে। রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণের চাবিকাঠি দলের হাতে। তাই দলেরই নেতৃবর্গ কেবিনেট সদস্যরা সাধারণ সদস্যদের উপর প্রাধান্য সৃষ্টি করতে পারে।

৪. প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব: প্রধানমন্ত্রী একাধারে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান, কমন্সসভার নেতা, কেবিনেটের প্রাণকেন্দ্র। কেবিনেটের একনায়কত্ব যেন ব্যক্তিত্বগুণে প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্বে পরিণত হয়েছে। তিনিই কেবিনেট পাতের স্টিয়ারিং হুইল। দলীয় শৃঙ্খলার মাধ্যমে পার্লামেন্টকে সুসংগঠিত করেন।

৫. অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইল: আইন প্রণয়ন পার্লামেন্টের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা হলেও নানা কারণে এ সংক্রান্ত কিছু ক্ষমতা পার্লামেন্ট শাসন বিভাগের হাতে হস্তান্তর করেছে। আদেশ, নির্দেশ, উপআইন, নিয়মনীতি প্রভৃতির মাধ্যমে শাসন বিভাগ যে আইন প্রণয়ন করে তাকে অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন বলে। ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় এ অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইনের পরিধি ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে ফলে কেবিনেটের কর্তৃত্বের পরিধিও ক্রমশ পরিব্যাপ্ত হচ্ছে।

৬. আইন প্রণয়নে নেতৃত্ব: কেবিনেট আইন প্রণয়ন কার্যের উপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। পার্লামেন্টে পেশ করা প্রতিটি আইনই কেবিনেট প্রস্তাব করে। কমন্সসভায় কেবিনেট সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজন থাকায় এর উত্থাপিত আইন সহজে অনুমোদিত হয়।

৭. যৌথ দায়িত্ব: পার্লামেন্টের সামনে কেবিনেট ঐক্যবদ্ধ ও সংহতিশীল সত্তা হিসেবে হাজির হয়। মন্ত্রীরা যৌথভাবে কমন্সসভার নিকট দায়ী থাকে। একজন মন্ত্রীর পতন হলে গোটা কেবিনেটের পতন হয়। তাই মন্ত্রীরা সমষ্টিগতভাবে কাজ করেই ক্ষমতাকে সুসংহত করে।

৮. আর্থিক ক্ষেত্রে কমলসভার গুরুত্ব হ্রাস: কমন্সসভা সরকারের ব্যয় বরাদ্দের দাবি গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ হ্রাস করতে পারে কিন্তু কোন অবস্থাতেই বৃদ্ধি করতে পারে না। উপরন্তু কমন্সসভার বাজেট ও অন্যান্য বিষয় আলোচনার জন্য সীমিত সময়ে বিস্তারিত আলোচনা ও কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব নয়। সাধারণ সদস্যদের ঔদাসীন্য আর্থিক ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করে তুলেছে।

৯. প্রধানমন্ত্রীর কমলসভা ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা: কমন্সসভায় শাসক দলের মধ্যে সরকারি নীতি সম্পর্কে গুরুতর মতপার্থক্য দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রী কমন্সসভা ভেঙে দেয়ার ভীতিপ্রদর্শন করতে পারেন। কমন্সসভা ভেঙে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ কেবিনেট কমন্সসভার সহযোগিতা ও সমর্থন লাভে সক্ষম হয়। কেবিনেটের এ – ক্ষমতা প্রসঙ্গে বেজহট (Bagehot) বলেছেন, “The cabinet is a creature but unlike other creatures it has the power of destroying its own creator.”

১০. নীতিনির্ধারণে কেবিনেটের ভূমিকা: ব্রিটিশ কেবিনেট নীতিনির্ধারণের একমাত্র কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে কমন্সসভা। কমন্সসভা ব্রিটিশ জাতির প্রধান রাজনৈতিক মঞ্চ, কিন্তু এ মঞ্চের পক্ষে সরকারের সকল নীতি সম্পর্কে
পর্যালোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবকাশ নেই। সহজ ভাষায়, সরকার নীতিনির্ধারক এবং কমঈসভা নীতি অনুমোদনকারী সংস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে।

১১. পার্লামেন্টারীয় বিধিনিয়ম: পার্লামেন্টে সকল সরকারি কার্যক্রম নিয়ে আলাপ আলোচনা করা হয়। প্রতিটি বিষয় আলোচনার সময় নির্দিষ্ট করা থাকে। প্রত্যেক দল নিজেদের বক্তা স্থির করে। এর ফলে প্রতিটি আলোচনাই সীমিত হয়ে পড়ে। এভাবে পার্লামেন্টারীয় নিয়মকানুনের অন্তরালে ব্রিটিশ কেবিনেট নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠার সুযোগ অর্জন করে।

১২. সরকারের কার্যপরিধি বৃদ্ধি: বর্তমান রাষ্ট্র কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। আর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মূলকথা হচ্ছে রাষ্ট্র এবং এর অন্তর্ভুক্ত জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধন। আর এর সাথে সাথে সরকারের কার্য ও ক্ষমতা সম্প্রসারিত হয়েছে।

১৩. সাধারণ বিল প্রণয়নে কেবিনেটের ক্ষমতা বৃদ্ধি: অর্থবিল ছাড়া অন্যান্য বিলের ক্ষেত্রে কেবিনেটের প্রাধান্য স্বীকৃত। সাধারণ বিলের বেশিরভাগই সরকারি বিল অর্থাৎ মন্ত্রিগণ কর্তৃক উত্থাপিত বিল। কমন্সসভায় শাসক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিদ্যমান। তাই বিরোধী দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও যে কোন সরকারি প্রস্তাব অনুমোদিত হচ্ছে। কমন্সসভার আইন প্রণয়ন ক্ষমতা অনেকটা তত্ত্বগত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

১৪. কমন্সসভার সদস্যগণের গুণগত মান হ্রাস: কমন্সসভার সদস্যগণের গুণগত মান হ্রাসের কারণে কেবিনেটের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং স্বাধীন মনোভাবাপন্ন সদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কমন্সসভায় বিতর্কের পরিমাণ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি ঐক্য বিনষ্ট হবে। এমতাবস্থায় কেবিনেটের নিয়ন্ত্রণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

খ. বাহ্যিক কারণ: বিংশ শতাব্দীতে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ, জাতীয় নিরাপত্তার অভাববোধ, উপনিবেশের শাসিত জনগণের জাতীয় মুক্তি সংক্রান্ত, ঔপনিবেশিক দেশসমূহের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা, গ্রেট ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। এর ফলে আন্তর্জাতিক বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারকে উনবিংশ শতাব্দীর তুলনায় অনেক বেশি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়েছে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, নানা কারণে ব্রিটিশ কেবিনেটের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রিটেনে কেবিনেটের ক্ষমতার এ অস্বাভাবিক বিস্তারকে অস্বীকার করা যায় না। তবে একই সাথে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কেবিনেটের ক্ষমতা বৃদ্ধিকে কোন কারণেই একনায়কত্বের সাথে তুলনা করা যায় না। কারণ সাম্প্রতিককালে কেবিনেটের একনায়কত্বের ধারণা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। বিগত কয়েক দশক ধরে কেবিনেটের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং বলা যায়, বর্তমানে ব্রিটিশ কেবিনেট নয়, প্রধানমন্ত্রীই একনায়কে পরিণত হয়েছে।