“ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থা একই সাথে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং গণতন্ত্র”- উক্তিটি পর্যালোচনা কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থা একই সাথে রাজতন্ত্র অভিজাততন্ত্র এবং গণতন্ত্র-উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: রাজতন্ত্র ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার একটি প্রাচীনতম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এটি ব্রিটিশ জাতির সম্মান ও শ্রদ্ধার প্রতীকরূপে বিবেচিত হয়। সুদীর্ঘকালের বিবর্তনের ধারায় ব্রিটিশ রাজতন্ত্র তার প্রায় নিরবচ্ছিন্ন অস্তিত্ব’ অটুট রেখেছে। ব্রিটেনের রাজতন্ত্র অভিজাততন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু ব্রিটেনে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় রাজতন্ত্র বা রাজশক্তির ক্ষমতা অনেক কমে গিয়েছে। অন্যদিকে, পার্লামেন্ট, কেবিনেট ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তত্ত্বগতভাবে ব্রিটেনে রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র বিরাজ করলেও বাস্তবে সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। কেননা রাজা বা রাণী বর্তমানে নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাই অনেকে মন্তব্য করেছেন, ব্রিটেনেয় বর্তমান শাসনব্যবস্থা একইসাথে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্র এর মিশ্রণ।

“ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থা একইসাথে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং পণতন্ত্র”: ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটেনে রাজতন্ত্র স্বীকৃত থাকলেও সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেখানে গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে রাজতন্ত্রের ক্ষমতা কিছুটা হলেও সংকুচিত হয়েছে, তবে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। আবার ব্রিটেনে অভিজাততন্ত্রের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। তাই বলা হয়ে থাকে, ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় একইসাথে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং গণতন্ত্রের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:

ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্র: ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় ‘রাজতন্ত্র’ একটি ঐতিহ্যবাহী সুত্রাচীন প্রতিষ্ঠান। এমন এক সময় ছিল যখন ব্রিটেনের রাজতন্ত্র ছিল স্বৈরতন্ত্রেরই নামান্তর। রাজার ক্ষমতা ছিল অসীম ও অপ্রতিহত। রাজা বা রাণী তখন প্রকৃত শাসনক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। ব্রিটেনে যে পর্যায়ে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা নিম্নে উল্লেখ করা হল।

১. শাসন বিভাগের প্রধান: আইনের দৃষ্টিতে ব্রিটেনের রাজা বা রাণী শাসন বিভাগের প্রধান এবং সকল ক্ষমতা তার হাতেই ন্যস্ত। অবশ্য রাজা বা রণী শাসন বিভাগীয় ক্ষমতা পরিচালনা করে থাকেন কমন্সসভার কাছে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মাধ্যমে।

২. শাসন বিভাগের কর্মকর্তা নিয়োগ: শাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে রাজা বা রাণী নিয়োগ সংক্রান্ত ব্যাপক ক্ষমতার
অধিকারী। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে অন্যান্য মন্ত্রিদের তিনি নিয়োগ দিয়ে থাকেন।এছাড়া শাসন বিভাগীয় সকল উচ্চপদস্থ কর্মচারী, বিচারক, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর অফিসারদের তিনি নিয়োগদান করেন। এছাড়া রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষমতা রাজা বা রাণীর হাতে ন্যস্ত।

৩. প্রতিরক্ষা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ: ব্রিটিশ রাজশক্তি প্রতিরক্ষা বাহিনীর নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত। কারণ রাজশক্তির নামেই যুদ্ধ, শান্তি ও নিরপেক্ষতা ঘোষণা করা হয়। রাজা বা রাণী ব্রিটিশ সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তিনি স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়োগদান করেন।

৪. বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা: ব্রিটিশ রাজশক্তিকে ন্যায়বিচারের উৎস বলে গণ্য করা হয়। রাজা বা রাণী উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের নিয়োগদান করেন। সকল ফৌজদারি মামলা রাজশক্তির নামে আনয়ন করা হয়। রাজা বা রাণী অপরাধীদেরকে ক্ষমা প্রদর্শন এবং দণ্ডাদেশ স্থগিত করতে পারেন।

৫. সম্মানের উৎস: ব্রিটেনের সম্মানসূচক উপাধি বণ্টনের ক্ষমতা রাজা বা রাণীর হাতে ন্যস্ত। ব্রিটেনের রাজা বা রাণী বিভিন্ন কাজের জন্য সমাজের বিভিন্ন স্তরের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদেরকে লর্ড, স্যার, লীয়ার উপাধি প্রদান করে থাকেন। বড়দিন, নববর্ষ, রাজা বা রাণীর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ব্রিটিশ রাজশক্তি প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলাদা করে বিভিন্ন সম্মানসূচক উপাধি প্রদান করে থাকেন।

৬. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান: ব্রিটেনের গির্জার প্রধান হলেন রাজা বা রাণী। তিনি গির্জার ধর্মযাজক এবং অন্যান্য
পুরোহিতকে নিয়োগ করেন এবং তার সম্মতিতেই খ্রিস্টধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, খ্রিস্টধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে রাজতন্ত্রের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্র: যেসব বিষয়ের কারণে ব্রিটেনে গণতন্ত্র চালু আছে বলা হয় সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হল:

১. কমন্সসভা: ব্রিটিশ কমন্সসভা গঠিত হয়েছে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত মর্যাদার ভিত্তিতে নয়। কারণ প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে কমন্সসভা গঠিত হয়ে থাকে। তাই ব্রিটেনের কমন্সসভাকে বলা হয় জনপ্রতিনিধিত্বমূলক কক্ষ এবং ব্রিটেনের গণতন্ত্রের প্রতীক।

২. ভোটাধিকার প্রয়োগ: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে ভোটাধিকার প্রয়োগ। ব্রিটেনের পার্লামেন্টের কার্যকরী কক্ষ কমন্সসভার সদস্যগণ সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে থাকেন এবং নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকেই প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রিদের নিয়োগ দেয়া হয়। আর এক্ষেত্রে জনগণ ভোটাধিকার ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ পায়, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

৩. রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি: একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব গণতন্ত্রের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে ব্রিটেনে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এবং এ ব্যবস্থাতেই ব্রিটেনের আপামর জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে, যা ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকরী করেছে।

৪. শাসন বিভাগের জবাবদিহিতা: ব্রিটেনে শাসন বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয় বলে এ শাসনব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ এখানে শাসন বিভাগ হিসেবে মন্ত্রিসভা কমন্সসভার নিকট জবাবদিহি করে থাকে। আর কমন্সসভার সদস্যগণ যেহেতু জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়, সেহেতু পরোক্ষভাবে তারা জনগণের নিকট জবাবদিহি করে থাকে।

৫. মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা: যে কোন শাসনব্যবস্থায় মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে বুঝায় যে কোন মাধ্যমের সাহায্যে তথ্যসংগ্রহ এবং নিজস্ব ধ্যানধারণার প্রচার। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ নাগরিকগণ মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। ব্রিটেনে প্রত্যেক নাগরিক সরকারের কাজের সমালোচনা করার অধিকার ভোগ করে থাকে।

ব্রিটেনে অভিজাততন্ত্র: ব্রিটেনে রাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মধ্যে অভিজাততন্ত্রও বিদ্যমান। আর ব্রিটেনে যেহেতু রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মিশ্রণ রয়েছে, তাই এখানে অভিজাততন্ত্রও বিদ্যমান। একদা ব্রিটিশ লর্ডসভার অপ্রতিহত ক্ষমতা ছিল। কালস্রোতে রাজতন্ত্রের মত লর্ডসভার ক্ষমতাও হ্রাস পেতে থাকে।লর্ডসভা ব্রিটেনের অভিজাত সম্প্রদায়ের একটি প্রতিষ্ঠান। House of Lord বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন আইন প্রণয়নকারী সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ। যদিও বর্তমানে লর্ডসভার আইন প্রণয়নের কোন ক্ষমতা নেই, তবুও সেখানে লর্ডদের আভিজাত্য বিদ্যমান রয়েছে।

লর্ডসভার আভিজাত্য: অভিজাততন্ত্রকে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা বলা হয়। লর্ডসভা ইংল্যান্ডের অভিজাত সম্প্রদায়ের একটি প্রতিষ্ঠান। সম্ভ্রান্ত বিত্তবান ও অভিজাত শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গের প্রতিনিধিত্বমূলক সভার নাম লর্ডসভা। লর্ডসভা হল বিশ্বের বৃহত্তম দ্বিতীয় কক্ষ। এর সদস্য সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, লর্ডসভার সদস্য সংখ্যা ১১০০ জনেরও বেশি। লর্ডগণ উত্তরাধিকারসূত্রে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। অভিজাত শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ করাই তাদের প্রধান কর্তব্য। লর্ডসভাকে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ আপিল আদালত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় লর্ডসভার তাৎপর্য অপরিসীম। লর্ডসভা যেসব সদস্যবর্গের সমন্বয়ে গঠিত তা নিচে উল্লেখ করা হল:

১. যুক্তরাজ্যের উত্তরাধিকারসূত্রে লর্ডগণ- ৮০৩ জন,

২. স্কটল্যান্ডের লর্ড প্রতিনিধিগণ- ১৬ জন।

৩. আয়ারল্যান্ডের লর্ড প্রতিনিধিগণ-৪ জন।

৪. আপিল আদালত লর্ডগণ- ৯ জন

৫. আর্চবিশপ ও অন্যান্য- ২১ জন ইত্যাদি।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্রিটেনে রাজতন্ত্রের সাথে অভিজাততন্ত্রের যেমন সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি গণতন্ত্রের সাথেও এদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কেননা এখানে সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকায় রাজা বা রাণী নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র টিকে রয়েছে। সুতরাং পরিশেষে বলা যায় যে, ব্রিটেনের সরকার ব্যবস্থা একই সাথে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত।