ব্রিটিশ সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো
ভুমিকা: গ্রেট ব্রিটেন একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। এখানে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রচালু রয়েছে। পার্লামেন্ট দ্বারা শাসিত। ব্রিটিশ
পার্লামেন্টকে বলা হয় “পার্লামেন্ট সমূহের জননী”। বিশ্বের প্রায় সকল গণতান্ত্রিক দেশের শাসন ব্যবস্থাই কমবেশী গ্রেট
ব্রিটেনের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ব্রিটেনের শাসনতন্ত্রকে আধুনিক শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।
ব্রিটিশ সংবিধান কোন নির্দিষ্ট গণপরিষদ কর্তৃক বা কোন বিপ্লবী পরিষদ কর্তৃক বা কোন রাজাদেশ বলে সৃষ্টি হয়নি, বরং
তা দীর্ঘ ঐতিহ্যের শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি বা প্রথার উপর প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটেনের সংবিধান অতি প্রাচীন হলেও, অবস্থার
পরিপ্রেক্ষিতে ইহা পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে যুগোপযোগী হয়ে উঠেছে। অধ্যাপক মন্রো উল্লেখ করেন ব্রিটেনের
সংবিধান রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠান সমূহের জটিল সংমিশ্রণ। ব্রিটিশ সংবিধান মূলত সনদ, চুক্তিপত্র আইন ও বিচার বিভাগের
সিদ্ধান্তএবং ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। ব্রিটিশ সংবিধান একটিমাত্র দলিল নয় বরং তা হাজারো দলিলের মিলিত
রূপ।
ব্রটেনের সংবিধানের কার্যকারিতা ও শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ বিচার করে সংবিধানের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো
লক্ষ্য করা যায়। যথাঃঅলিখিত সংবিধান ঃ
ব্রিটিশ সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটি একটি অলিখিত শাসনতন্ত্র। এ সংবিধানের এমন কোন দলিল
নেই, যেখানে ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কিত মূল বিধানগুলো উল্লিখিত আছে। এই সংবিধান সাধারণ
আইন, বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত, লোকাচার, প্রথা প্রভৃতির মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। অবশ্য এই সংবিধানের
অধিকাংশ অংশ অলিখিত আকারে থাকলেও এর কিছু কিছু লিখিত উপকরণও রয়েছে। যেমন ঃ ১২১৫
খ্রীষ্টাব্দের ম্যাগনাকার্টা (গধমহধ পযধৎঃধ), ১৬২৮ খ্রীষ্টাব্দের পিটিশন অব রাইটাস্ (চবঃরঃরড়হ ড়ভ
জরমযঃং), ১৭০১ খ্রীষ্টাব্দের অ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট (অপঃ ড়ভ ঝবঃঃষবসবহঃ), ১৯১১ ও ১৯৪৯ সালের
পার্লামেন্ট অ্যাক্টগুলো (চধৎষরধসবহঃ ড়ভ অপঃং) প্রভৃতি ব্রিটিশ সংবিধানের স্তম্ভ স্বরূপ।
বিবর্তনশীলতা বা গতিশীলতা ঃ
ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর প্রবাহমানতা বা গতিশীলতা। ব্রিটিশ সংবিধান যেহেতু কোন
সংস্থা কর্তৃক তৈরি হয় নি, সেহেতু এটা জনগণের প্রয়োজন মেটাতে চলমান পরিস্থিতির সাথে ক্রমশঃ খাপ
খাইয়ে নিয়ে যুগ যুগ ধরে স্বাভাবিক নিয়মে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বর্তমান রূপ লাভ করেছে।
হাজার বৎসরের প্রবাহমানতায় কোন ছেদ পড়েনি। অধ্যাপক জেনিংস (ঔবহহরহমং) এর মতে, “ব্রিটিশ
সংবিধান তৈরি করা হয় নাই, ধীরে ধীরে এটা জন্ম লাভ করেছে।”
নমনীয়তা ঃ
এ সংবিধানের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল এটি সুপরিবর্তনীয় ও নমনীয় প্রকৃতির । এ সংবিধান পরিবর্তন
করতে কোন বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয় না। সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতিতে সংবিধান পরিবর্তন
করা যায়। এতে কোন জটিলতা সৃষ্টি হয় না। এ সংবিধানে শাসনতান্ত্রিক আইন ও সাধারণ আইনের মধ্যে
কোন পার্থক্য নেই। এই নমনীয়তার কারণে ব্রিটিশ সংবিধান সব সময়ই যুগের প্রয়োজনের সাথে খাপ
খাইয়ে চলতে সক্ষম হয়েছে। তবে, ব্রিটিশ সংবিধানকে নমনীয় বললেও কার্যতঃ ইংরেজদের
রক্ষণশীলতার জন্য এটা তেমন সুপরিবর্তনীয় নয়। ব্রিটিশ আইনে কোন গুরুত্বপূর্ণপরিবর্তন সাধন করতে
হলে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়।
তত্ত্ব ও বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান ঃ
এ সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর অবাস্তবতা। এতে তত্ত্বও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যেমনঃ
তত্ত্বগত ভাবে ব্রিটেনের শাসন বিভাগের ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে ন্যস্তহয়েছে রাজার উপর, কিন্তু কার্যত তা
ক্যাবিনেট প্রয়োগ করে। আবার আইনের চোখে ক্যাবিনেটের কোন অস্তিত্ব নেই। সংবিধান মোতাবেক
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু অনেক লেখক মনে করেন ব্রিটিশ কেবিনেট সেই
ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে।
এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা ঃ
এ সংবিধান অনুযায়ী, গ্রেট ব্রিটেন এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই সব ক্ষমতা ন্যস্ত।
গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি স্বীকৃতি পায়নি। স্বতন্ত্রীকরণের পরিবর্তে এখানে
সহযোগিতার মন্ত্রই উচ্চারিত রয়েছে।
পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ঃ
ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণবৈশিষ্ট্য হচ্ছ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব। পার্লামেন্ট যে কোন বিষয়ে
আইন তৈরী, বাতিল বা সংশোধন করতে পারে। আদালত পার্লামেন্টের সকল আইনকেই বৈধ বলে
প্রয়োগ করে। আদালত এই আইনকে বাতিল করতে পারেনা। এ প্রসঙ্গে, ডাইসির অভিমত, “পার্লামেন্ট
সব প্রকারের আইন প্রণয়ন করতে পারে, সর্ব প্রকারের আইন বাতিল করতে পারে এবং ব্রিটেনে এমন
কোন কর্তৃপক্ষ নেই যা পার্লামেন্ট প্রণীত আইনকে বলবৎ করতে অস্বীকার করতে পারে।” তাই ডি লোমী
বলেন “ ব্রিটেনের পার্লামেন্টের ক্ষমতা এত ব্যাপক যে, তা নারীকে পুরুষ এবং পুরুষকে নারীতে রূপান্তরিত
করা ব্যতীত সকল কার্যই সম্পন্ন করতে পারে।”
সরকারের দায়িত্বশীলতা ঃ
ব্রিটেনের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণবৈশিষ্ট্য হল-এর দায়িত্বশীলতা। এই সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেগঠিত
মন্ত্রিপরিষদ তথা শাসন বিভাগ ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে আইনপরিষদের নিকট দায়ী থেকে শাসনকার্য
নির্বাহ করে। অনাস্থা প্রস্তাব, মূলতবী প্রস্তাব, নিন্দা প্রস্তাব, প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার মাধ্যমে আইন পরিষদ
মন্ত্রিপরিষদকে নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি করতে বাধ্য করে।
নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রঃ
ব্রিটেনের সংবিধান বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। ব্রিটেনে
পার্লামেন্ট, মন্ত্রিপরিষদ, ক্যাবিনেট প্রভৃতি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও বংশানুক্রমিক প্রতিষ্ঠান
রাজতন্ত্রটিকে আছে। তবে ব্রিটেনে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রটিকে থাকলেও রাজা বা রানী এখানে নামেমাত্র
সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। বাস্তবে তাঁর ক্ষমতা অত্যন্তসীমিত। এ প্রসঙ্গে অগ্ বলেন, “গ্রেট ব্রিটেনের
শাসন ব্যবস্থা আইনত অবাধ রাজতন্ত্র, তবে তা কার্যতঃ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রছাড়া কিছুই নয়।”
প্রথার প্রাধান্য ঃ
ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল প্রথার প্রভাব। প্রথা ব্রিটিশ সংবিধানের প্রাথমিক উপাদানস্বরূপ
এবং এগুলো সরকারের বাস্তব কার্যকারিতাকে যথেষ্ট পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রথার প্রভাবের ফলে এ
সংবিধান মূলত অলিখিত সংবিধানে রূপান্তরিত হয়েছে।
আইনের শাসন ঃ
আইনের শাসন ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং তা এ সংবিধানকে মহীয়ান করে তুলেছে।
আইনের অনুশাসনের অর্থ (ক) স্পষ্টভাবে আইন লঙ্ঘন না করলে কাউকেই দৈহিক অথবা আর্থিক ভাবে
শাস্তিপ্রদান করা যাবে না (খ) আইনের চোখে সকলেই সমান ও (গ) মৌলিক অধিকারগুলো বিচার
বিভাগের সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতি। আইনের অনুশাসনের বলেই ব্রিটিশবাসী পূর্ণনাগরিক স্বাধীনতার গ্যারান্টি
লাভ করেন।
জেনিংসের মতে, ব্রিটিশ সংবিধানের চারটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত: তা গণতান্ত্রিক
(ফবসড়পৎধঃরপ), দ্বিতীয়ত: তা সংসদীয় তৃতীয়ত: রাজতন্ত্রের লক্ষণ রয়েছে, চতুর্থত: এতে ক্যাবিনেটের
প্রাধান্য রয়েছে ইত্যদি। সি, এফ, স্ট্রং যথার্থই বলেছেন, “ব্রিটেনের সংবিধান যে কোন সংকট ছাড়াই
পরিবর্তিত হয়েছে এবং হঠকারিতা ও আন্দোলন ছাড়াই উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে।”
সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা ঃ
ব্রিটেনের শাসনতন্ত্রেসংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। শাসন বিভাগ তার কাজের জন্য আইন বিভাগের
নিকট দায়ী থাকে। আইনসভা অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে শাসন বিভাগ অর্থাৎ মন্ত্রিসভাকে ভেঙে দিতে
পারে।
নাগরিক অধিকার ঃ
ব্রিটেনের শাসনতন্ত্রেনাগরিকের কি কি অধিকার থাকবে তা স্পষ্টভাবে কোথাও বলা হয়নি। বরং নাগরিকের
কি কি অধিকার নেই তা বলা হয়েছে। যেমন ঃ রাজদ্রোহ, কুৎসা প্রচার, অন্য ধর্মের প্রতি অমর্যাদাকর
আচরণ ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি ঃ
ব্রিটেনের শাসনতন্ত্রেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসৃত হয় নি। এ প্রসঙ্গে রবসন
বলেন, “ ইংল্যান্ডের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের বিশেষ কোন সন্ধান পাওয়া যায় না।
তবে পার্লামেন্ট শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের দৈনন্দিন কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করে না।”
উপসংহার: ব্রিটিশ সংবিধান অসংখ্য প্রথা, লোকাচার ও রীতিনীতির সমষ্টি। এ সংবিধান রাজতন্ত্রও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের এক অদ্ভূত সংমিশ্রণ। ব্রিটেনের শাসনতন্ত্রএকটি দলিলে লিপিবদ্ধ নয়। অতীতের ঐতিহ্যেলালিত ক্রমবিবর্তনের ধারায় ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রবিকাশ লাভ করেছে।