অথবা, ব্রিটিশ রাজতন্ত্র বা রাজশক্তির ক্ষমতার উৎসসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ‘Anglo Saxon’ এবং Norman যুগ হতে উদ্ভূত হয়। এমন এক সময় ছিল যখন রাজা বা রাণী ছিলেন ‘Real Chief Executive, কিন্তু ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে রাজা বা রাণীর কর্তৃত্ব, প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্বের স্থলে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাজশক্তি একটি ‘Constitutional Institution’ এ পরিণত হয়। এ প্রেক্ষাপটেই বলা হয়, ‘The King or Queen reigns but does not govern তথাপি ন্যায়বিচারের উৎস হিসেবে ব্রিটেনের রাজা বা রাণী জনগণের কাছে অত্যন্ত সম্মানীয়। সাংবিধানিক ও ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্রিটিশ জনগণের কাছে রাজশক্তি মূল্যবোধের প্রতীক। বর্তমানে ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজশক্তি যাবতীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ করে থাকে।
রাজতন্ত্র বা রাজশক্তির ক্ষমতার উৎস: তত্ত্বগত দিক থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তি বিপুল ক্ষমতার অধিকারী। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সকল কার্যক্রম রাজা বা রাণীর নামেই সম্পাদিত হয়। শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞ মহল বলেছেন, ব্রিটেনের রাজশক্তির এ বিপুল ক্ষমতার উৎস মূলত দু’টি। যথা:
১. পার্লামেন্ট প্রণীত আইন এবং
২. রাজশক্তির বিশেষাধিকার।
নিফ ব্রিটেনের রাজশক্তির ক্ষমতার উৎসগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হল:
১. পার্লামেন্ট প্রণীত আইন: ব্রিটিশ রাজশক্তির ক্ষমতার অন্যতম প্রধান উৎসগুলো পার্লামেন্ট প্রণীত আইন। বর্তমানে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে রাজা বা রাণীকে যে ক্ষমতা প্রদান করেছে, সেসব ক্ষমতা দ্বারাই সরকারি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এছাড়া অর্পিত ক্ষমতা দ্বারা মন্ত্রীরা প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন তৈরি করে প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকে। পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইনসমূহ রাজা বা রাণীর নামে শাসন বিভাগ প্রয়োগ করে থাকে। বর্তমানে ব্রিটেনে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রচলিত বিধায় ধনিক ও বণিক শ্রেণীরা প্রতিনিধিত্ব করছে। তাই আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ব্রিটিশ রাজশক্তি পার্লামেন্ট প্রণীত আইন দ্বারা যেসব ক্ষমতা ভোগ করেন তা নিচে কর্ণনা করা হল:
ক. শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা: তত্ত্বগতভাবে ব্রিটিশ সরকারের সকল শাসন বিভাগীয় ক্ষমতা রাজা বা রাণীর হাতে ন্যস্ত থাকে। রাজা বা রাণী হলেন শাসন বিভাগের প্রধান এবং শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। শাসন বিভাগীয় সকল উচ্চপদস্থ কর্মচারী, বিচারক, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর অফিসারদের তিনি নিয়োগদান করেন। রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য
কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষমতা রাজা বা রাণীর হাতে ন্যস্ত।
খ. আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা: রাজা বা রাণী হলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রাজা বা রাণী পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান, স্থগিত এবং বাতিল করতে পারেন। তিনি লর্ডসভা এবং কমন্সসভার পরামর্শ ও অনুমতিক্রমে আইন প্রণয়ন করে থাকেন। কোন বিল কমন্সসভা এবং লর্ডসভা কর্তৃক গৃহীত হলেও তা রাজা বা রাণীর অনুমোদন ছাড়া আইনে পরিণত হবে না।
২. রাজশক্তির বিশেষাধিকার: রাজশক্তির বিশেষাধিকার সম্পর্কে ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রে কোন লিখিত প্রমাণ নেই। রাজশক্তির বা রাজতন্ত্রের বিশেষাধিকার সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক যেসব মতামত দিয়েছেন তাই এর দলিল বা প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়। Black Stone বলেছেন, “রাজশক্তির বিশেষাধিকার হল সেসব ক্ষমতা, যেগুলোর ভিত্তিতে রাজকীয় মর্যাদা অনুসারে অন্যান্য সকলের উপর রাজার বিশেষ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত এবং যেগুলো প্রথাগত আইনের বাইরে।” আবার Prof. Dicey বলেছেন, “The residue of discretionary or arbitrary authority which at any time is legally left in the hands of the crown.” বর্তমান সময়ে ব্রিটিশ রাজশক্তির যেসব বিশেষাধিকার রয়েছে, সেগুলো নিম্ন আলোচিত হল:
ক. প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ: ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিকক্ষ কমন্সসভার সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে ব্রিটিশ রাজশক্তি অর্থাৎ রাজা বা রাণী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। কোন কারণে যদি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন, তবে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজা বা রাণী পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগময় মুহূর্তে রাজশক্তি প্রধানমন্ত্রীর উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারেন। ব্রিটিশ রাজশক্তি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে প্রাধান্য দেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জেনিংস বলেছেন, “The Queen has one and one function of primary importance, it is to appoint a Prime Minister.”
খ. অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ: অতীতে ব্রিটিশ রাজশক্তি নিজস্ব পছন্দমতো ব্যক্তিদেরকে মন্ত্রী নিয়োগ করতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক দলের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজশক্তির ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার পরামর্শে রাজশক্তি অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ করে থাকেন।
গ. পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা: ব্রিটিশ রাজশক্তির বিশেষাধিকারের একটি অন্যতম ক্ষমতা হল পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বলতে রাজা বা রাণী সমেত লর্ডসভা ও কমন্সসভাকে বুঝায়। রাজশক্তি পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান, স্থগিত বা পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে পারেন। তবে এসব কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে ব্রিটিশ রাজশক্তি করে থাকেন।
ঘ. সরকারকে অপসারণ: ব্রিটিশ রাজশক্তির আরেকটি প্রধান বিশেষাধিকার হল সরকারকে অপসারণ করা। ব্রিটেনে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকায় রাজশক্তি প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করলেই সরকারের পতন ঘটে। বর্তমানে সরকারের পতন ঘটানো রাজশক্তির উপর নির্ভরশীল নয়, যদিও সরকার পতনের ঘটনা রাজশক্তির মাধ্যমে হয়। কারণ সরকার যদি পার্লামেন্টের আস্থা হারান, তখন ঐ সরকারের পতন ঘটে। রাজা বা রাণী শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন।
ঙ. সামরিক ক্ষমতা: ব্রিটিশ রাজশক্তির বিশেষাধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হল সামরিক ক্ষমতা। রাজশক্তির নামেই যুদ্ধ, শান্তি ও নিরপেক্ষতা ঘোষণা করা হয়। রাজা বা রাণী ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তিনি স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়োগদান করেন।
চ. পররাষ্ট্র বিষয়ক ক্ষমতা: ব্রিটিশ রাজশক্তির অপর বিশেষাধিকার হল পররাষ্ট্র বিষয়ক ক্ষমতা। বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনা করা ও নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব রাজশক্তির হাতে ন্যস্ত। বিদেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ, বিদেশি রাষ্ট্রদূত গ্রহণ, আন্তর্জাতিক চুক্তিসম্পাদন প্রভৃতি রাজশক্তির নামেই সম্পাদিত হয়।
ছ. বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা: ব্রিটিশ রাজশক্তির অন্যতম প্রধান বিশেষাধিকার হল বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা। রাজশক্তিকে ন্যায়বিচারের উৎস বলে মনে করা হয়। রাজা বা রাণী উচ্চ আদালতের বিচারপতিদেরকে নিয়োগদান করেন। সকল ফৌজদারি মামলা রাজশক্তির নামে আনয়ন করা হয়। রাজা বা রাণী অপরাধীদেরকে ক্ষমা প্রদর্শন এবং দণ্ডাদেশ স্থগিত করতে পারেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্রিটিশ রাজশক্তি যেসব ক্ষমতা প্রয়োগ করেন,
সেগুলো অনেক দিনের বিবর্তনের ফল। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজশক্তির ক্ষমতা কিছুটা লোশ পেয়েছে। তবে ব্রিটিশ সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত থাকায় রাজশক্তি একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ফলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজশক্তিরও ক্ষমতা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষকরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নতুন নতুন আইন প্রণীত হওয়ার সাথে সাথে রাজতন্ত্রের ক্ষমতাও একটু একটু বৃদ্ধি পায়।