ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশে ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা আলোচনা কর।

অথবা, ব্রিটিশ ভারতে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টিতে ব্রিটিশ সরকারের Divide and Rule Policy বা ভাগ কর, শাসন কর নীতি দায়ী আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারত একটি বিশাল সাম্রাজ্য এবং এতে বিভিন্ন সম্প্রদায় রয়েছে। অতীতে তারা বিভিন্ন শাসকের অধীনে একত্রে বসবাস করেছে, কিন্তু ইংরেজদের আমল থেকে মূলত এ সম্প্রদায়ের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়। এর কারণ শুধু সাম্প্রদায়িক ভিন্নতা নয় বরং এর উল্লেখযোগ্য কারণ হলো ব্রিটিশ সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থা। বিশাল এ সাম্রাজ্যকে ব্রিটিশরা কেবল শক্তির মাধ্যমে দীর্ঘকাল শাসন করা সম্ভব ছিল না। তারা এর জন্য অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করেন তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর পদ্ধতি ছিল Divide and Rule Policy.
ভাগ কর শাসন কর নীতি : এর মূল কথা হলো ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণি নির্বিশেষে জনগণের মধ্য জাতিগত ঐক্য তৈরির বদলে তাদের সাম্প্রদায়িক ঐক্য তৈরি করে সম্প্রদায়গুলোকে একে অন্যের বিরোধী করা।
ভাগ কর শাসন কর নীতি প্রয়োগ : ভারতে দুটি প্রধান সম্প্রদায় ছিল হিন্দু ও মুসলিম। ব্রিটিশরা এ দুটি সম্প্রদায়কে একে অন্যের বিরোধী করতে তৎপর ছিল। তারা প্রথম থেকেই বিভিন্ন বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করে এবং সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ করে। প্রথম দিকে ভাগ কর শাসন কর নীতি প্রয়োগ ছিল কিছুটা এমন- ক.
মুসলমানদের সুযোগ সুবিধার প্রতি অবহেলা দেখানো, অন্যদিকে হিন্দুদের সব ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেওয়া। খ. হিন্দুদের ব্যবসায় বাণিজ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মুসলমানদের তুলনায় অধিক সুযোগ সুবিধা প্রদান, গ. ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তন এর মাধ্যমে ফরাসি ভাষায় শিক্ষিত মুসলমানদের পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া। ভূমি ব্যবস্থাসহ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এর মাধ্যমে হিন্দু জমিদার ও মুসলমান প্রজাদের মধ্যে অবস্থার অবনতি ঘটবে না ইত্যাদি বিষয়কে হিন্দু ও মুসলমানদের অন্তরায় এনে প্রথম দিকে ইংরেজরা তাদের প্রতিপক্ষকে দমনের চেষ্টা করে এবং তারা সফলও হয়।
ভাগ কর শাসন কর নীতির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ : ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের এ নীতির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হয়। কারণ সেই সময় ভারতীয় দল কংগ্রেস থেকে ভারতের স্বাধীনতার রব তুলছিল। ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের এ প্রচেষ্টা দমনের জন্য সরাসরি ভাগ কর শাসন কর নীতির প্রয়োগ করে এবং কংগ্রেসের অধিক প্রভাবান্বিত অঞ্চল বাংলাকে বিভক্ত করে। যদিও বাংলা বিভক্তির জন্য প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণ দেখানো হয় কিন্তু এর পিছনে যে ব্রিটিশ
সরকারের সুচিন্তিত কৌশল ছিল তা পরবর্তীতে প্রমাণ হয়। এবার হিন্দুদের দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের
টেনে নেয়, তাদের ভাগ্য উন্নতির কথা বলে হিন্দুদের তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। সুতরাং অনিবার্য ফল হিসেবে আমরা ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ দেখতে পাই, যদিও ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ টিকিয়ে রাখতে পারেনি কিন্তু তাদের মূল উদ্দেশ্য তত দিনে সফল হয়। হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্ক চিরদিনের জন্য বিপর্যয় হয়। তারা একে অন্যের শত্রুতে পরিণত হয়। ১৯০৫ সালের পর থেকে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিষয় ঘনীভূত হতে থাকে এবং উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরপর বিভিন্ন সময় ব্রিটিশ সরকার তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য একবার মুসলমানের আবার কখনো হিন্দুদের পক্ষ নেয় কিন্তু তাদের মধ্যকার সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না। ১৯০৯ সালে মর্লি মিন্টো আইন ব্রিটিশ সরকারের আর একটি ভাগ কর শাসক কর নীতির বহিঃপ্রকাশ হয়। এর মাধ্যমে মুসলমানকে সর্বপ্রথম পৃথক নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এর ফলে পৃথক নির্বাচন নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে আবার বিরোধ সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ
সরকারের যাওয়ার আগ মুহূর্তে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরো বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশরা চলে গেলে ভারতের শাসনভার কে নিবে এ প্রশ্নে প্রায় ১৯৪০ সাল থেকে বিরোধ সৃষ্টি হয়। ১৯৪০ সালে জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে লাহোর প্রস্তাবে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমির দাবি করা হয়। হিন্দুরা এর বিরোধিতা করে, তারা ভারত বিভক্তির পক্ষে ছিল না। ১৯৪০ সাল থেকে এ নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা হয়। হাজার হাজার মানুষ এসব দাঙ্গায় প্রাণ হারায়। এর মধ্যে ১৯৪৬ সালে ১৬ আগস্ট এর কোলকাতার ভয়াবহ দাঙ্গা উল্লেখযোগ্য। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে এসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বৃদ্ধির কারণে ব্রিটিশ সরকার ভারতকে বিভক্তি করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯৪৭ সালে ভারতকে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতের এ নির্মম সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশের পিছনে যতটা না ধর্মীয় কারণ উল্লেখযোগ্য তার চেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য হলো ব্রিটিশ সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক পদ্ধতি অর্থাৎ Divide and Rule Policy বা ভাগ কর শাসন নীতি। এ নীতির মাধ্যমে দীর্ঘকাল ধরে পাশাপাশি বসবাসকারী ভারতের দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যকার সম্পর্ক এতটাই অবনতি হয় যে তার ফলাফল আমরা দেখতে পাই ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির ফলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের সৃষ্টি।