ব্রিটিশ কেবিনেট কমন্সসভাকে কিভাবে এবং কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করে?এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ কেবিনেটের কাম্য কি না, আলোচনা কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

উত্তরঃ ভূমিকা: উনবিংশ শতাব্দীতে পার্লামেন্ট তথা কমন্সসভার সার্বভৌমত্ব ছিল ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার একটি
বড় বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এ অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে কমন্সসভার সার্বভৌমত্ব ও প্রাধান্য স্বীকৃত। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কেবিনেট বা মন্ত্রিসভাই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী এবং এটা কমন্সসভাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এজন্য অধ্যাপক মুর (Muir) বলেছেন, “Today it is not the House of Commons which controls the cabinet but the cabinet which controls the house.”

ব্রিটিশ কেবিনেট বা মন্ত্রিসভা বা মন্ত্রিপরিষদ কিভাবে এবং কতটুকু কমন্সসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে: ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় তত্ত্বগতভাবে পার্লামেন্ট ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী হলেও বাস্তবে শাসন বিভাগ সেই ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। ফলে কেবিনেট কমন্সসভার উপর নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়েছে। যেসব পদ্ধতিতে বা উপায়ে ব্রিটিশ কেবিনেট বা মন্ত্রিপরিষদ কমন্সসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে তা নিলে আলোচনা করা হল:

১. সুশৃঙ্খল দলীয় ব্যবস্থা: বর্তমানে ব্রিটিশ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুশৃঙ্খল দলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান। দলীয় শৃঙ্খলার কারণে ব্রিটেনে মন্ত্রিসভা বা কেবিনেট কমন্সসভার উপর কর্তৃত্ব করে থাকে। কমন্সসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার সমর্থন
থাকে বিধায় মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় থাকে। দলীয় কোন সদস্য কমন্সসভায় কেবিনেটের বিরোধিতা করলে তাকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কারের ভয়ে সকল সদস্যই কেবিনেটকে সমর্থন দিয়ে যায়। কেবিনেট সদস্যগণ দলীয় নেতাও বটে। দলীয় নির্দেশ অমান্য করার সাহস তারা পায় না। ফলে দলীয় নেতাদের নির্দেশের প্রতি তারা সবসময় অনুগত থাকেন।

২. কমলসভা ভেঙে দেয়ার হুমকি: কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাই হলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি কেবিনেটে
সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম (First among the equals)। কমন্সসভার অনাস্থা প্রস্তাব পাস হলে প্রধানমন্ত্রী রাজা ব্য রাণীর সাথে পরামর্শ করে কমন্সসভা ভেঙে দিতে পারে। কমন্সসভা ভেঙে দিলে নতুনভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ নির্বাচন অনেকের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলতে পারে। আবার প্রধানমন্ত্রী অনাস্থা উত্থাপনকারী সদস্যগণকে নতুন নির্বাচনে মনোনয়ন দান নাও করতে পারে। এরূপ অবস্থার সম্মুখীন হতে কেউ চায় না। কাজেই তার সাধারণ কেবিনেটকে সহযোগিতা দিয়ে যায় এবং কেবিনেটের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে।

৩. অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন: অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত (Delegated legislation) আইনের মাধ্যমে কেবিনেটের প্রভাব ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আইন প্রণয়নের কাজ পার্লামেন্টের অর্থাৎ কমন্সসভার। কিন্তু পার্লামেন্ট এ দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে পারে না। ফলে কেবিনেটের পক্ষে কমন্সসভাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজতর হয়ে পড়ে।

৪. কেবিনেটের যৌথ ক্ষমতা: ব্রিটিশ কেবিনেট কমন্সলভাকে নিয়ন্ত্রণ করার অন্যতম কারণ হল কেবিনেট মন্ত্রীদের যৌথ দায়িত্বশীলতা। কেবিনেট যৌথভাবে কমন্সসভার নিকট দায়িত্বশীল থাকে। পার্লামেন্টের আস্থা হারালে কেবিনেটকে
পদত্যাগ করতে হয়। এজন্য কেবিনেট ঐক্যবদ্ধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে যাবতীয় কার্যসম্পাদন করে।
কেবিনেটের এ যৌথ দায়িত্বশীলতা ও ঐক্যবদ্ধ রূপই তাদের সুসংহত ও পদমর্যাদা সাধনে সহায়তা করছে।

৫. কমন্সসভার বৃহদাকৃতি: বৃহদায়তনবিশিষ্ট কমন্সসভার বিপুল সংখ্যক সদস্য যে কোন বিষয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে চাইলে স্পিকারের পক্ষে তাদের এ ইচ্ছা পূরণ করা সম্ভব হয় না। এজন্য শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়া অন্যান্য সদস্য
কমন্সসভার ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে উদাসীন থাকে। বৃহদাকৃতির জন্য কমন্সসভা সরকারি আইন বিভাগ হিসেবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে না। ফলে কেবিনেট বা মন্ত্রিসভা সহজেই কমন্সসভাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।

৬. সংযোগ সাধনকারীর ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা: সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে সংযোগ রক্ষার সেতুবন্ধন হিসেবে ভূমিকা পালন করা কমন্সসভার কর্তব্য। কিন্তু কমন্সসভা এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ফলে কেবিনেটের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

৭. কমলসভার অক্ষমতা: কমন্সসভার সদস্যদের গুণগত মান হ্রাস পাওয়ায় পার্লামেন্টের সদস্যগণ প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারে না। ফলে কেবিনেট সদস্যগণ তাদের দক্ষতা ও বিচক্ষণতা দিয়ে সহজেই পার্লামেন্টকে নিয়ন্ত্রণ
করতে পারে।

৮. সুযোগ সুবিধা প্রদান: কমন্সসভায় ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী সদস্যদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার তাদের মধ্যে বিভিন্ন পদ ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বিতরণ করে থাকেন। কাজেই কেবিনেটের বিরোধিতা করার মত সক্ষম সদস্য কমে যায়। ফলে কেবিনেটের পক্ষে কমন্সসভাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব সহজ হয়।

৯. জনসাধারণের মানসিকতা: ব্রিটিশ জনসাধারণের চিন্তাভাবনা ও মানসিকতায় কেবিনেটের প্রভাব সহায়ক হয়েছে। ব্রিটিশ জনসাধারণ এ ধারণা পোষণ করে যে, পার্লামেন্ট সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হলেও রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নে কেরিনেটের ভূমিকা চূড়ান্ত। কমন্সসভা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলেও দলীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি অনুযায়ী শাসন বিভাগের নিকট আত্মসমর্পণ করতে হয়।

১০. উচ্চাভিলাষ: কমন্সসভায় সরকার দলীয় সদস্যগণ মন্ত্রী হওয়ার এবং সাধারণ মন্ত্রিগণ কেবিনেট মন্ত্রী হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। প্রধানমন্ত্রী খুশি থাকলে তা সম্ভব হতে পারে। এ আশায় কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যগণ প্রধানমন্ত্রী তথা কেবিনেটের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন।

কেবিনেটের নিয়ন্ত্রণ কাম্য কি না: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে একথা বলা যায় যে, ব্রিটেনের কেবিনেট বা মন্ত্রিসভা বিভিন্ন উপায়ে কমন্সসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে কমন্সসভার উপর কেবিনেটের যতই নিয়ন্ত্রণ থাকুক না কেন, কেবিনেটকে বা মন্ত্রিসভাকে কমন্সসভার নিকট দায়িত্বশীল থাকতে হয়। কেননা কমন্সসভার আস্থা হারালে মন্ত্রিপরিষদ পদত্যাগ করতে বাধ্য। তাছাড়া কমন্সসভা অনাস্থা প্রস্তাব, মুলতুবি প্রস্তাব, নিন্দা প্রস্তাব, ছাঁটাই প্রস্তাব ইত্যাদির মাধ্যমে কেবিনেট বা মন্ত্রিসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে বর্তমানে সুশৃঙ্খল দলীয় ব্যবস্থার উদ্ভবের ফলে কেবিনেটের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তাই অনেক সমালোচক কেবিনেট কর্তৃক কমন্সসভার নিয়ন্ত্রণকে সমালোচনার দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেছেন। তাদের দৃষ্টিতে কেবিনেট কর্তৃক কমন্সসভার নিয়ন্ত্রণ কাম্য নয়। কারণ সেক্ষেত্রে কেবিনেটের স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি পাবে এবং জনগণের অধিকার ক্ষুন্ন হবে। সুতরাং বলা যায় যে, ব্রিটিশ কেবিনেট কর্তৃক কমন্সসভার এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ কাম্য নয়।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কমন্সসভার সদস্যগণ জনগণের প্রতিনিধি। তাঁদের মাধ্যমেই মন্ত্রিগণ বা কেবিনেট জনগণের কাছে দায়ী থাকেন। তাই কেবিনেট কর্তৃক কমন্সসভাকে নিয়ন্ত্রণ করা দায়িত্বশীল সরকারের কাম্য নয়। তবে যত কথাই বলা হোক না কেন জনমত, আইনের শাসন, পার্লামেন্টের সমালোচনা এবং অনাস্থার ঝুঁকি কেবিনেটকে সবসময়ই সংযত রাখে। তাই বলা যায়, ব্রিটেনের প্রকৃত সার্বভৌম পার্লামেন্ট বা কেবিনেট নয়, প্রকৃত সার্বভৌম জনমত বা জনগণ। এজন্য জনৈক লেখক বলেছেন, “The real sovereign in England is the public opinion.”