অথবা, ব্রিটিশ কেবিনেটের ক্ষমতা বৃদ্ধির কী কী কারণ বিদ্যমান উল্লেখ কর। অথবা, ব্রিটিশ কেবিনেটের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণগুলো বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হল কেবিনেট। প্রকৃতপক্ষে ব্রিটেনের শাসন পরিচালনার আসল দায়িত্ব কেবিনেটের উপরই ন্যস্ত। ব্রিটেনের কেবিনেট ব্যবস্থা সাংবিধানিক রীতিনীতি ও প্রথার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। তাই এর সিদ্ধান্ত ও নীতির কোন আইনগত স্বীকৃতি নেই। ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় কেবিনেটের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে Ramsay Muir কেবিনেটকে “The steering wheel of the ship of the state” বলে অভিহিত করেছেন।
ব্রিটিশ কেবিনেটের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ: পার্লামেন্টের ক্ষমতা হ্রাস এবং ব্রিটিশ কেবিনেটের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণসমূহকে দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
ক.অভ্যন্তরীণ কারণ ও
খ. বাহ্যিক কারণ।
ক.অভ্যন্তরীণ কারণ: নিঢ় কেবিনেটের ক্ষমতা বৃদ্ধির অভ্যন্তরীণ কারণসমূহ আলোচনা করা হল:
১. জনমতের প্রাধান্য: বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। এ যুগে জনমত অত্যন্ত দ্রুত গঠিত হয়। মানুষ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। ফলে সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ ঘনিষ্ঠতর হয়। আর এর ফলে
কেবিনেটের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়।
২. সুশৃঙ্খল দলীয় ব্যবস্থার উদ্ভব: যুক্তরাজ্যে সুশৃঙ্খল দলীয় ব্যবস্থার আবির্ভাব কেবিনেটের ক্ষমতা বৃদ্ধিয় অন্যতম কারণ। ব্যয়বহুল নির্বাচনে কোন ব্যক্তির পক্ষে দল নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয়লাভ সম্ভব হয় না। তাই দলীয় ছত্রছায়ায় তাদের বাধ্য হতে হয়। তাছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তিত হওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃবৃন্দই কেবিনেটে স্থান পায়।দলীয় নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা মানে উপেক্ষাকারীর রাজনৈতিক অপমৃত্যু। এরূপ দলীয় ব্যবস্থা কেবিনেটকে ক্ষমতাশালী করেছে।
৩. বিল পাসে কমলসভার গুরুত্ব হ্রাস: তত্ত্বগতভাবে আইন প্রণয়নের অধিকারী হল পার্লামেন্ট। কিন্তু বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃবৃন্দই নীতিনির্ধারণ কিংবা আইন প্রণয়নের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী। যেহেতু ঐ দলনেতাকে নিয়ে কেবিনেট গঠিত হয়, সেহেতু সভায় তারা যে বিল উত্থাপন করেন দলীয় প্রতিনিধিরা নির্দ্বিধায় তা মেনে নেন যা কেবিনেটের ক্ষমতাকে আরও বৃদ্ধি করেছে।
৪. আর্থিক ক্ষেত্রে কমলসভার গুরুত্ব হ্রাস: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকারি আয়ব্যয়ের উপর পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ
সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে। কিন্তু বর্তমানে এ নিয়ন্ত্রণ আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে কেবিনেট যে বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করে তার পিছনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সমর্থন থাকায় তা অবলীলাক্রমে পাস হয়ে যায়। তাছাড়া অল্প সময়ের আলোচনা এবং বাজেটের মত জটিল বিষয়ে আলোচনার জন্য যে বিশেষ জ্ঞান প্রয়োজন তা কমন্সসভার সদস্যদের নেই বললেই চলে। যার ফলে আর্থিক ক্ষেত্রে কমন্সসকার ভূমিকা হ্রাস পেয়েছে, পরিণামে কেবিনেটের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
৫. অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন: বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের মত পার্লামেন্টের পক্ষে যাবতীয় বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আইন প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। পার্লামেন্ট আইনের মূলনীতি নির্ধারণ করে সেগুলোকে পরিপূর্ণতা দানের ক্ষমতা শাসন বিভাগের হাতে অর্পণ করে। শাসন বিভাগ আদেশ, নির্দেশ জারি করে কিংবা নিয়মকানুন, উপআইন ইত্যাদি
প্রণয়ন করে উক্ত মূল আইনগুলোকে পরিপূর্ণতা দান করে যাকে ‘অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইন’ বলে বিবেচিত। যার জন্য
কেবিনেটের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
৬. কেবিনেটের যৌথ দায়িত্ব: সরকার কর্তৃক সম্পাদিত কার্যাবলির জন্য সমগ্র কেবিনেটকে কমন্সসভার নিকট
যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। একজন মন্ত্রীর ভুলত্রুটির জন্য সমগ্র কেবিনেটকেই পদত্যাগ করতে হয়। এর ফলেমকেবিনেট ঐক্যবদ্ধভাবে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে যাবতীয় কার্যসম্পাদন করে। কেবিনেটের ঐ ঐক্যবদ্ধ রূপই তার ক্ষমতাকে সুসংহত এবং তার পদমর্যাদার বৃদ্ধিসাধন করেছে।
৭. সম শ্রেণীস্বার্থের সুদৃঢ় বন্ধন: যুক্তরাজ্যের পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজের প্রভুত্বকারী ধনিক ও বণিক শ্রেণী প্রচার কৌশলে জনগণকে বিভ্রান্ত করে কমন্সসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সমর্থ হয়েছে। এ শ্রেণী নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করেছে, তাদেরই নেতৃবৃন্দকে দিয়ে গঠিত কেবিনেটের হাতে। এ শ্রেণীস্বার্থের বন্ধনই কেবিনেটকে অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী করে তুলেছে।
৮. প্রধানমন্ত্রীর পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা: কমন্সসভার আস্থা হারালে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয় এমন। কোন কথা নেই। এরূপ পরিস্থিতি হলে প্রধানমন্ত্রী রাজা বা রাণীকে কমন্সসভা ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দিতে পারেন এবং নিয়মতান্ত্রিক শাসক হিসেবে রাজা বা রাণী সেটা উপেক্ষা করতে পারেন না। ফলে অনেক সদস্যই পুনর্নির্বাচিত হতে না
পারার ভয়ে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে সাহস পায় না। কেবিনেট এমনি এক সংগঠনে পরিণত হয়েছে, যা তার স্রষ্টাকে ধ্বংস করতে পারে।
৯. কমলসভার বৃহদাকৃতি: বৃহদায়তন বিশিষ্ট কমন্সসভার বিপুলসংখ্যক সদস্য যে কোন বিষয়ে আলোচনাঁ করতে চাইলে অধ্যক্ষের পক্ষে তাদের সে ইচ্ছা পূরণ করা সম্ভব হয় না। কার্যত সরকারি ও বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ ছাড়া অন্যান্য সদস্য কম সুযোগ পান বলে তাদের মনে এক ধরনের হতাশা দেখা দেয়। বৃহদাকৃতির জন্য কমন্সসভা সরকারের আইন বিভাগ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে না। তেমনি কেবিনেটকে নিয়ন্ত্রণ করতেও ব্যর্থ হয়। ফলে কেবিনেটের উপর কমন্সসভার নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে কমন্সসভার উপর কেবিনেটের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
১০. কমন্সসভার সংযোগ সাধনের ক্ষমতা হ্রাস: পূর্বে কমন্সসভা সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগসাধনে কিছু সাফল্য অর্জন করলেও বর্তমানে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতাই অধিক পরিমাণে চোখে পড়ে। এর জন্য দায়ী বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী ও পেশাদারি সংস্থার আবির্ভাব। ঐসব গোষ্ঠী এবং সংস্থা নিজেদের দাবিদাওয়া পূরণের জন্য সরকার এবং পদস্থ আমলাদের সাথে যোগাযোগ করে। তাদের কাছে কমন্সসভার একজন প্রভাবশালী সদস্য অপেক্ষা প্রভাব প্রতিপত্তিহীন একজন মন্ত্রীর আকর্ষণ অনেক বেশি, যার ফলে কেবিনেটের প্রাধান্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
১১. সরকারের কার্যপরিধি বৃদ্ধি: আজকাল সরকারের ক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও বর্তমান সরকারকে বহু উন্নয়নমূলক কার্যসম্পাদন করতে হয়। বর্তমান কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মূলকথা হচ্ছে রাষ্ট্র এবং এর অন্তর্ভুক্ত জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধন। আর এর সাথে সাথে সরকারের কার্য ও ক্ষমতা সম্প্রসারিত হচ্ছে।
খ. বাহ্যিক কারণ: বিংশ শতাব্দীতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, জাতীয় নিরাপত্তার অভাববোধ, উপনিবেশের শাসিত জনগণের জাতীয় মুক্তি সংক্রান্ত, ঔপনিবেশিক দেশসমূহের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা গ্রেট ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বর্তমান সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির সাথে সাথে
সরকারের কার্যপরিধি বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের ধারণা তাই জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছে। ফলে সরকারের ক্ষমতাও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্রিটেনে সংসদীয় ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে কেবিনেট ব্যবস্থার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই আজ ব্রিটিশ কেবিনেট কমন্সসভার তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। সরকারি নীতিনির্ধারণ হতে জরু করে আইন প্রণয়নের চূড়ান্ত ক্ষমতা কেবিনেটের হাতে। ফলে ব্রিটেনে পার্লামেন্টের একনায়কত্বের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কেবিনেটের একনায়কত্ব।