অথবা, ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার প্রকৃতি আলোচনা কর।
অথবা, ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার মানদণ্ড বর্ণনা কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা : সমাজকর্মী সাহায্যার্থীকে তার সমস্যা সমাধানে যে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করে চলেন তাকে ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া বলা যায়। অর্থাৎ সাহায্যার্থীর সমস্যা মোকাবিলায় ব্যক্তি সমাজকর্ম কর্তৃক যে বিজ্ঞানসম্মত কার্যপ্রণালি গ্রহণ করা হয় তাকে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া বলা হয়।
ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য : কতিপয় বৈশিষ্ট্য ‘সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া’ হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্মকে অন্যান্য সমাধান প্রক্রিয়া থেকে আলাদা সত্তা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মর্যাদা দান
করেছে। যেমন- সাগর১. সাধারণ নীতি ও মূল্যবোধের অনুসরণ : সমস্যা সমাধানে সুশৃঙ্খল উপায়ে সাহায্য করার জন্য ব্যক্তি
সমাজকর্মীদের সর্বাবস্থায় কতকগুলো সাধারণ নীতিমালা ও মূল্যবোধ অনুসরণ করতে হয়। যেমন- ব্যক্তি মর্যাদার স্বীকৃতি,
আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার দান, গোপনীয়তা রক্ষা প্রভৃতি।
২. বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ব্যবহার : মানুষের চাহিদা, আচরণ, আবেগ, ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তি ও পরিস্থিতি, সামাজিক পরিবেশ, সামাজিক সমস্যা, দ্বন্দ্ব ও তার প্রভাব প্রভৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানার্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ব্যবহার করে থাকেন।
৩. মানবীয় আচরণ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন : সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সমাধানে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সাহায্য করার জন্য সমাজকর্মীদের মৌলিক মানবিক আচরণ, সামাজিক সম্পর্ক, ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে হয়। এসব জ্ঞানের মূল উৎস হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক আচরণগত বিজ্ঞান।
৪. সুনির্দিষ্ট কর্মপ্রক্রিয়ার ব্যবহার : সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্মের সুনির্দিষ্ট কর্মপ্রক্রিয়া রয়েছে। সাহায্যার্থীর সাথে সমাজকর্মীর প্রথম সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং সমস্যা সমাধানের মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। সমস্যা সমাধানের এ দীর্ঘ ও ধারাবাহিক কর্মপ্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কতকগুলো স্তর অতিক্রম করতে হয়।
৫. স্বতন্ত্রীকরণ করা : ‘ব্যক্তি ও সমস্যার স্বতন্ত্রীকরণ’ সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্মকে তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার অধিকারী করেছে।
৬. বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতি গুরুত্বারোপ : সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ ও পরিচালনার জন্য ব্যক্তি সমাজকর্ম পেশাদার কর্মীর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার উপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এ সমাধান প্রক্রিয়ায় আত্মনির্ভরশীল হয়ে কাজ করার জন্য পেশাদার কর্মীর অন্ততপক্ষে চার থেকে ছয় বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। অন্য কোন সমাধান প্রক্রিয়া পেশাদার কর্মীর এ ধরনের অভিজ্ঞতার প্রতি গুরুত্ব দেয় না।
৭. সামাজিক গবেষণার সহায়তা গ্রহণ : সমাজ নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থায় সমাধান প্রক্রিয়াকে বাস্তবমুখী ও কার্যকর রাখার জন্য ব্যক্তি সমাজকর্ম প্রতিনিয়ত সামাজিক গবেষণার সাহায্য নিয়ে থাকে।
৮. সাহায্যদানের সুনির্দিষ্ট কৌশল অবলম্বন : সাহায্যার্থীর সমস্যার প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য এবং ধরন অনুযায়ী ব্যক্তি সমাজকর্মে সুনির্দিষ্ট কৌশল রয়েছে। এতে কখনো প্রত্যক্ষ সমর্থনমূলক আবার কখনো পরোক্ষ সংশোধনমূলক কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চালানো হয়।
৯. সুনির্দিষ্ট ধাপ বা স্তর অতিক্রম : ব্যক্তি সমাজকর্ম ব্যক্তির সমস্যা সমাধানে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ধাপ বা স্তর অতিক্রম করে। সেগুলো হচ্ছে- তথ্যসংগ্রহ, সমস্যা নির্ণয়, সমাধান
, মূল্যায়ন ও অনুসরণ। প্রতিটি স্তরে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান দেয়া হয়।
১০. সামাজিক ভূমিকা পালনে সক্ষম করা : ব্যক্তি সমাজকর্মে সমাধান ব্যবস্থা সমাজকর্ম প্রক্রিয়ার এমন এক পদক্ষেপ যা একটি সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত কাঠামোর মধ্যে ব্যক্তি ও পরিবারকে সামাজিক ভূমিকা পালন এবং নির্দিষ্ট ক্ষেত্রসমূহে অভিযোজন ক্ষমতার পুনরুদ্ধার জোরদার ও উন্নতিবিধানের ব্যাপারে সক্ষম করে তোলে । ব্যক্তি সমাজকর্মে সমাধান প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ‘ব্যক্তি ও পরিবেশ’। সমাধানের জন্য ব্যক্তি ও পরিবেশের এমন কোন দিক নেই যেখানে গুরুত্ব দেয়া না হয়। তাছাড়া ব্যক্তি ও তার পরিবারকে সবসময়ই ‘জৈব-মনোসামাজিক
একক’ হিসেবে বিচার করা হয়। অন্য কোন পেশাতে যে কোন সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য এসব উপাদানকে গুরুত্ব দেয়া অত্যাবশ্যক। আলোচনার ভিত্তিতে একথা অনস্বীকার্য যে, ব্যক্তি সমাজকর্ম প্রক্রিয়া শুরু হয় সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি ও তার সমস্যা নিয়ে এবং এ প্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটে সমস্যার সমাধান দিয়ে ব্যক্তিকে স্বাবলম্বী করে তার সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক ভূমিকা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে। তাই যুক্তিসংগতভাবে বলা যায়, ‘সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্ম সার্থক,
বাস্তবমুখী এবং গতিশীল।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, মক্কেলের স্বাভাবিক জীবনযাপন ও স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করাই ব্যক্তি সমাজকর্মের মূল লক্ষ্য। তাই সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া হিসেবে এটি একটি সার্থক ও সফল
পদ্ধতি বলা যায়। সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতি একটি সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।