ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া বলতে কী বুঝ? ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় যেসব পর্যায় অনুসরণ করা হয় সেগুলো আলোচনা কর।

অথবা, ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার যে কোন তিনটি স্তর উল্লেখপূর্বক সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় সাহায্যার্থীর অংশগ্রহণের তাৎপর্য উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সাধারণভাবে প্রক্রিয়া হলো কোন কর্ম সম্পাদনের ধারাবাহিক ও গতিশীল কর্মপ্রণালি। ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া বলতে সাহায্যার্থীর সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গৃহীত ধারাবাহিক কার্যপ্রণালিকে বুঝায়। ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া হলো একটি ধারাবাহিক গতিশীল কর্মপ্রবাহ। ব্যক্তি সমাজকর্মী অথবা এজেন্সির
নিকট সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সেবা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে এ ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার সূচনা, সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে এর পরিসমাপ্তি ঘটে।
ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার স্তর : যে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করে সমাজকর্মী তার মক্কেলকে সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে থাকেন তাকে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া বলা হয়। এটি একটি ধারাবাহিক ও
দীর্ঘমেয়াদি কর্মপ্রণালি। সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়াকে কয়েকটি পর্যায়ে বা স্তরে ভাগ করা যায়। যথা :
১. সমস্যা বাছাইকরণ ;
২.সমস্যা সমাধান পরিকল্পনা;
৩. সমস্যা নির্ণয়;
৪.অনুধ্যান;
৫. সমস্যার পূর্বাভাস ও আপাত ব্যবস্থা;
৬. মূল্যায়ন;
৭. অনুসরণ ও
৮.সমাপ্তি।
নিম্নে তিনটি স্তর সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১. সমস্যা বাছাইকরণ : সাহায্যার্থীর বহু ধরনের সমস্যা থাকে। কিন্তু সব ধরনের সমস্যা সমাধান করার মত পেশাগত যোগ্যতা ও দক্ষতা কোন সমাজকর্মীরই থাকে না। অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠানেরও সীমাবদ্ধতা থাকে। কাজেই প্রথম সাক্ষাৎকারেই সমাজকর্মী তার প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা অনুযায়ী সাহায্যার্থীকে গ্রহণ কিংবা অন্য প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ সম্পর্কে
সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
২. অনুধ্যান : এ পর্যায়ের তথ্যাবলির যথার্থতার উপর ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার সফলতা বিশেষভাবে নির্ভর করে। সাহায্যার্থীর সমস্যা এবং তার সমাধানের সাথে সংশ্লিষ্ট সার্বিক তথ্যাদি অনুধ্যানের মাধ্যমেই সংগ্রহ করতে হয় । তথ্যসংগ্রহের জন্য সমাজকর্মী নিম্নলিখিত কৌশল প্রয়োগ করে থাকেন । যথা :
ক. সাক্ষাৎকার,
খ. গৃহ পরিদর্শন,
গ. যোগাযোগ ও পরামর্শ,
ঘ. পর্যবেক্ষণ এবং
ঙ. অতীত ঘটনাবলির সংরক্ষিত নথিপত্র।
৩. সমস্যা নির্ণয় : সমস্যা নির্ণয় হলো একটি মানসিক প্রক্রিয়া, যা অনুধ্যানের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যাদির বিভিন্ন দিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সমস্যার প্রকৃতি, গঠন, পারস্পরিক সম্পর্ক, কারণ এবং সমাধানের উপায় প্রভৃতি যাচাই করে দেখার জন্য যে চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি পরিচালনা করা হয় তাকে সমস্যা নির্ণয় বলে। সমস্যা নির্ণয় বা উরধমহড়ংরং তিন প্রকার । যথা : ক. গতিশীল সমস্যা নির্ণয়, খ. চিকিৎসামূলক সমস্যা নির্ণয় এবং গ. সমস্যার উৎপত্তিগত ডায়াগনসিস।
সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় সাহায্যার্থীর অংশগ্রহণের গুরুত্ব : ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় সাহায্যার্থীর অংশগ্রহণ বিভিন্ন দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সাহায্যার্থীর উদ্দেশ্যবহ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার জন্য পরিচালিত সমস্যা সমাধানমূলক ব্যবস্থাকে কার্যকর ও ফলদায়ক করা হয়। সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া শুরু হয় সমাজকর্মীর সাথে সাহায্যার্থীর প্রথম যোগাযোগের মধ্য দিয়ে এবং শেষ হয় প্রত্যাশিত পরিবর্তন ধারায় সন্তুষ্টির একটি
স্তর অর্জন পর্যন্ত। সে কারণে গোটা প্রক্রিয়াটি যেখানে অনুধ্যান, সমস্যা নির্ণয় এবং সেবা সুবিধা প্রদানের একটি সমন্বিত কর্মধারায় ব্যাপ্ত সেখানে প্রতিটি পর্যায়েই সাহায্যার্থীর অংশগ্রহণ আবশ্যক। সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে বা পর্য ায়ে সাহায্যার্থীর অংশগ্রহণের যেসব কারণে গুরুত্ব রয়েছে নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. অনুধ্যান (Study) : সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি কর্তৃক উপস্থাপিত সমস্যাকে সমাজকর্মী পেশাগত দিক থেকে বুঝতে হয় ও অনুধ্যান করতে হয়। সেজন্য সাহায্যার্থীর কথা, অনুভূতি, চিন্তা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ করার প্রয়োজন পড়ে। তদুপরি ব্যক্তি তার সমস্যার অভিজ্ঞতাকে বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রকাশ করতে ও স্পষ্ট করতে দক্ষ। সুতরাং তথ্যসংগ্রহের
মাধ্যমে সমস্যাকে জানতে কিংবা সমস্যার স্বরূপ প্রকৃতি বুঝতে সাহায্যার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণ দরকার। উদাহরণস্বরূপ, একজন কিশোর অপরাধীর কথা বলা যায়। এক্ষেত্রে একজন সমাজকর্মী উক্ত অপরাধীর আচরণ বুঝতে তার নিজস্ব ব্যাখ্যাকে গুরুত্ব দিতে হয়। এতে কিশোর অপরাধী নিজের বিচ্যুত আচরণের কারণ ও ধরন প্রকৃতি সম্পর্কে যে তথ্য দিবে তা সমস্যার অনুধ্যানে সহায়ক। আর এরূপ তথ্য প্রাপ্তি অনুধ্যানকালে কিশোর অপরাধীর সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্ভব।
২. সমস্যা নির্ণয় (Diagnosis) : সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিই ভালোভাবে জানে সে কি রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় উপনীত। সে আলোকে সে তার বর্তমান অবস্থা উত্তরণের সম্ভাব্য সামর্থ্য ও পন্থার কথাও চিন্তা করে। সমস্যা নির্ণয়ে যদি তার ধ্যানধারণা ও প্রত্যাশার সংযোগ থাকে তবে সমস্যাকেও সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সহজতর হবে। সে
লক্ষ্যে সমস্যা নির্ণয়কালে সাহায্যার্থীর অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে আমাদের দেশের আলোচিত কিশোর অপরাধ সমস্যার কথা বলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কিশোর অপরাধীর বর্তমান আচরণের ধরন কি এবং তাদের মুক্ত হওয়ার পন্থা কি হতে পারে সে ব্যাপারে কিশোর অপরাধীর অভিজ্ঞতা ও
চিন্তাভাবনা দেখতে গেলে সমস্যা নির্ণয়মূলক তৎপরতায় তার অংশগ্রহণ আবশ্যক। কেননা তাতে তার সাথে বিভিন্ন আলোচনা পর্যালোচনার ভিতর দিয়ে সুষ্ঠুভাবে সমস্যা নির্ণয় করা যায়।
৩. সেবাদান (Treatment) : সেবা প্রদানকালে সাহায্যার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। বস্তুত সমাজকর্মী সেবা সুবিধার ব্যাপারটি দ্বিপক্ষীয় তৎপরতা। এক্ষেত্রে সমাজকর্মীর সহায়তা নিয়ে সাহায্যার্থীর নিজ সমস্যা মোকাবিলায় সক্ষমতা লাভ করে। যেমন- কিশোর অপরাধের সংশোধন প্রক্রিয়া সমাজকর্মীর সাহায্য সমর্থন গ্রহণ এবং সে আলোকে অপরাধী নিজেকে সংশোধনে সক্রিয় থাকলে তার অপরাধমূলক আচরণ দূর হবে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় সাহায্যার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমেও সমাজকর্মীর সেবা গৃহীত ও পরিচালিত। এক্ষেত্রে সমাজকর্মীর চেয়েও সাহায্যার্থীকে অধিক সক্রিয় ও দায়িত্বশীল হতে হয়। কেননা সমস্যায় সে নিজে আক্রান্ত হয়, তার তৎপরতাই পরিত্রাণ প্রয়াসে মুখ্য এবং তার দায়িত্বশীল ভূমিকার মধ্য দিয়ে আসবে পরিবর্তন।