অথবা, সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্মের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক দেখাও।
অথবা, সমস্যা সমাধান পদ্ধতির স্তরগুলো আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সাধারণভাবে প্রক্রিয়া হলো কোন কর্মসম্পাদনের ধারাবাহিক ও গতিশীল কর্মপ্রণালি। ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া বলতে সাহায্যার্থীর সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গৃহীত ধারাবাহিক কার্যপ্রণালিকে বুঝায়। ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া হলো একটি ধারাবাহিক গতিশীল কর্মপ্রবাহ। ব্যক্তি সমাজকর্মী অথবা এজেন্সির
নিকট সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সেবা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে এ ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার সূচনা, সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে এর পরিসমাপ্তি ঘটে।
সমস্যা সমাধান পদ্ধতির পদক্ষেপসমূহ : সুশৃঙ্খল ও পদ্ধতিগতভাবে ব্যক্তির সমস্যা বিশ্লেষণ করে সমাধানের উদ্দেশ্যে ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ গৃহীত হয়ে থাকে। মূল পদক্ষেপ (Principal steps)
১. মনোসামাজিক অনুধ্যান (Psycho-social study)
২. সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় (Diagnosis / assessment)
৩. সমাধান ব্যবস্থা (Treatment)
- মূল্যায়ন (Evaluation)।
আনুষঙ্গিক পদক্ষেপ (Relevant steps)
১. অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা (Prognosis)
২. অনুসরণ (Follow up)
৩. সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ (Referral)।
নিম্নে এ পদক্ষেপগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
মূল পদক্ষেপ (Principal steps)
১. মনোসামাজিক অনুধ্যান (Psycho-social study) : ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সমস্যার যথাযথ অনুধ্যান বা Study. ব্যক্তি সমাজকর্ম প্রক্রিয়ার এ স্তরে ব্যক্তির সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়সমূহের মনোসামাজিক দিক অনুধ্যান করা হয় বলে এটাকে মনোসামাজিক অনুধ্যান
(Psycho social) বলা হয়। ব্যক্তি সমাজকর্মের এ অনুধ্যানমূলক গবেষণা বা অনুসন্ধান কার্যক্রমকে নির্দেশ করে যা Case বা সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত ও সুস্পষ্ট করে। তবে এ প্রক্রিয়ায় Case বা Problem বলতে সেই সমস্ত সমস্যা বা বিষয়কে বুঝায় যা
সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যমান থাকে এবং যেগুলো পৃথকভাবে সমাধানের প্রয়োজন হয়। তাই বলা যায়, ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় মনোসামাজিক অনুধ্যান হচ্ছে ব্যক্তির মানসিক ও সামাজিক সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়ের পাশাপাশি সেগুলোর যথাযথ সমাধান পরিকল্পনা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যসংগ্রহের কৌশল।
২. সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় (Diagnosis / Assessment) : সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় বলতে ব্যক্তি ও সমাজ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য এবং প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া হয় এমন সাহায্য সম্বলিত কর্মপ্রয়াসের একটি সুষ্ঠু নকশা বা পরিকল্পনাকে বুঝায়। সমাজকর্ম প্রক্রিয়ায় আভিধানিক অর্থে সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় হচ্ছে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি বা সাহায্যার্থীর ব্যক্তিত্ব ও তার মনোসামাজিক অবস্থা বা সমস্যার সঠিক সংজ্ঞায় পৌঁছার পর এক নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস। এ বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে
হলে এরূপ বলা যায় যে, এটি এক সচেতন মানসিক কর্মপ্রয়াস যাতে সাহায্যার্থী ব্যক্তির সার্বিক ধারণা, স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান, আন্দাজ, অন্তর্দৃষ্টি ও তার অসম্পূর্ণ চিন্তাভাবনা ইত্যাদি অত্যন্ত শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে গুছিয়ে তার সমস্যার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় । সুশৃঙ্খল এ সমস্যা নির্ণয় প্রক্রিয়ায় সাধারণত দুটি বিশেষ দিকের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করা হয় । যথা :
ক. ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও সমস্যা শনাক্তকরণ ও খ. সমাধান পরিকল্পনা প্রণয়ন।
৩. সমাধান ব্যবস্থা (Treatment) : ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক পর্যায়ে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির মনোসামাজিক সমস্যাসমূহ অনুধ্যানের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সমস্যার স্বরূপ প্রকৃতি নির্ণয় করা হয়। পরবর্তীতে নির্ণীত সমস্যা কার্যকরীভাবে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে সমাধান ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত কাঠামোর আওতায় ব্যক্তি ও তার পরিবারের সামাজিক ভূমিকা পালন ও অভিযোজন ক্ষমতা পুনরুদ্ধার ও উন্নয়নের প্রচেষ্টা গৃহীত হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে সমাধান ব্যবস্থার কার্যক্রম শুরু হয় ব্যক্তি সমাজকর্মীর সাথে সাক্ষাতের শুরু থেকে এবং ব্যক্তি সমাজকর্ম প্রক্রিয়ায় শেষপর্যন্ত এটি চলতে থাকে। অর্থাৎ বলা যায়, মনোসামাজিক অনুধ্যান ও সমস্যা নির্ণয়ের ন্যায় চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে সমাধান ব্যবস্থা ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধানের সার্বিক প্রক্রিয়াকে গতিশীল রাখতে এবং উদ্দেশ্যকে কার্যকরীভাবে অর্জনের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক কৌশল হিসেবে কাজ করে।
৪. মূল্যায়ন (Evaluation) : ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো মূল্যায়ন যার মাধ্যমে গৃহীত কার্যক্রমের সফলতা ও ব্যর্থতা পরিমাপ করা হয়। সমস্যা সমাধান সহায়তা করার জন্য যেসব কার্যক্রম গৃহীত হয় সেগুলোর যাচাইবাছাই ( Assessment) হলো মূল্যায়ন। আপাতদৃষ্টিতে মূল্যায়ন কার্যসমাপ্তির পর সম্পন্ন হয় বলে মনে করা হলেও ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার অন্যান্য স্তরের এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
মূল্যায়নের লক্ষণীয় বিষয় হলো সেবাকার্যক্রম উদ্দেশ্য অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে কি না, সাহায্যার্থীর সামর্থ্য ও ক্ষমতার বিকাশ ঘটছে কি না, সমস্যা মোকাবিলায় সাহায্যার্থী সক্ষম হয়ে উঠেছে কি না ইত্যাদি। মূল্যায়ন সাধারণত দু’রকম।
যথা : (ক) ক্রমাগত মূল্যায়ন ও (খ) মেয়াদি মূল্যায়ন।
আনুষঙ্গিক পদক্ষেপ (Relevant steps)
১. অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা (Prognosis) : ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা নিরূপণ প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পর্যায়কে সমস্যা সমাধান কার্যক্রমে অন্তর্বর্তীকাল বলা হয়। অর্থাৎ সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ের সমস্যার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া (যেমন- উদ্বিগ্নতা, অস্থিরতা, উত্তেজনা, চাপ অনুভব ইত্যাদি) থেকে সাহায্যার্থীকে সাময়িকভাবে মুক্ত করার লক্ষ্যে যেসব হয় সেগুলোকে Prognosis বা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা বলে। ব্যবস্থা গৃহীত
সাধারণত সমস্যাগ্রস্ত কোন ব্যক্তি যখন এজেন্সির সাহায্যের জন্য আগমন করে তখন তার মধ্যে এক ধরনের চাপমূলক অবস্থা ও অস্বস্তি বিরাজ করে। এ অবস্থায় তার নিকট হতে পর্যাপ্ত তথ্যসংগ্রহ অসম্ভব হয়ে পড়ে বা সমস্যা নির্ণয় ও সমাধান পরিকল্পনা তৈরিতেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে সাহায্যার্থীর মধ্যে সাময়িক স্বস্তিরভাব ফিরে আসে। তাই ব্যক্তিকে অপেক্ষাকৃত সহজে বুঝার জন্য এই সাময়িক উপশমকারী ব্যবস্থা গৃহীত হয় ।
২. অনুসরণ (Follow up) : ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যার প্রকৃতি, সময়, পরিবেশের পরিবর্তনের ফলে ব্যক্তির আচরণের ধরনও বদলে যেতে পারে। সমস্যার ক্ষেত্রে যে সমাধান ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা মূল বিষয় বা ভিত্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মনোভাব বা আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে পরিবর্তন দেখা দেয়া বিচিত্র নয়। তাই সমাধান ব্যবস্থার কার্যকারিতা অবলোকন ও যাচাই করার উদ্দেশ্যে ফলোআপ বা অনুসরণ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা
হয়। সমাজকর্মে ফলোআপ বা অনুসরণ প্রক্রিয়াকে বিশেষ একটি পরি এক ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করা হয়। এ অবস্থা ব্যক্তির বাস্তব জীবনে উন্নতি বা তির ধারা মূল্যায়ন এবং সে প্রেক্ষিতে নতুন সমাধান ব্যবস্থা সংযোজিত হয়।
৭. প্রেরণ (Referral) : সমস্যার প্রকৃতি বা কারণভেদে সাহায্যার্থীকে উপযুক্ত স্থানে বা প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করার বিষয় সমাজকর্ম পেশার অন্যতম নীতি। ব্যক্তির সমস্যার গতিপ্রকৃতি দেখে তাকে অনেক সময় সমাজকর্মী অন্য প্রতিষ্ঠানেও প্রেরণ করতে পারেন। কারণ উক্ত ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা সমাজকর্মীর নাও থাকতে পারে। কিংবা সমাজকর্মী যে প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন সে প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিকে সাহায্য করার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্যের উপকরণ নাও থাকতে পারে। প্রেরণের এ কাজটি কোন কোন সময় সমাজকর্ম প্রক্রিয়ার শুরুতে অনুধাবন করা সম্ভব হয়। আবার কখনও তা নির্ণয় করতে বিলম্ব হতে পারে।
ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান পদ্ধতির বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক :
ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার সহায়ক ও মৌল পদক্ষেপগুলো পৃথকভাবে আলোচনা করা হলেও এদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান।
১. ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার সাফল্য ও কার্যকারিতা নির্ভর করে এই বিভিন্ন স্তরের কার্যক্রম বা পদক্ষেপগুলোর সফল বাস্তবায়নের উপর।
২. এ পদক্ষেপগুলোর ঘাতিক কার্যক্রম একটি অন্যটির উপর নির্ভরশীল। যার ফলে কোন স্তরের ব্যর্থতা তার পরবর্তী কার্যক্রম নেতিবা চক প্রভাব ফেলে।
৩. বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সময় যুগপৎভাবে সবগুলো পদক্ষেপ একসঙ্গে গ্রহণ করা হয়। যেমন আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির সমস্যা সমাধানে সাহায্য করার জন্য প্রারম্ভিক পর্যায়ে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে
হয়। অনেক সময় প্রথম স্তরেই শেষ স্তরের কার্য সমাধা করতে হয়।
৪. এসব পদক্ষেপগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের যথাযথ প্রয়োগ ব্যক্তি সমাজকর্ম প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হয়।
তাই বলা যায় যে, সার্বিক সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ বা স্তর বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ব্যক্তি সমাজকর্ম সমস্যাগ্রস্ত মানুষকে সমস্যা সমাধানে সক্ষমকারী পদ্ধতির সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো সমস্যার বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়। এদের যথাযথ
প্রয়োগের উপর সমস্যা সমাধান কার্যক্রম নির্ভরশীল। পদক্ষেপগুলোর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা রয়েছে। যার ফলে একটা ব্যতিরেকে অন্যটি সফলভাবে সম্পন্ন করা যায় না। তাই সার্বিক সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তর বা পদক্ষেপ গুরুত্বের দাবি রাখে।