অথবা, বৈভাষিক সম্প্রদায়ের বাহ্য-প্রত্যক্ষবাদ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাহ্য-প্ৰত্যক্ষবাদ সম্পর্কে বৈভাষিক সম্প্রদায়ের অভিমত কী?
উত্তর৷৷ ভূমিকা : গৌতম বুদ্ধের (খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দ- খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দ) বাণী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠেছে সে মতবাদই ‘বৌদ্ধ দর্শন’ বা ‘বৌদ্ধধর্ম।’ বুদ্ধদেবের অনুগামীদের সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে এবং বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম ও দর্শনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রায় ত্রিশটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে বলে জানা যায়। এই সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বৈভাষিক সম্প্রদায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিম্নে প্রশ্নপত্রের আলোকে বৈভাষিক সম্প্রদায়ের বাহ্যানুমেয়বাদ আলোচনা করা হলো :
বৈভাষিক সম্প্রদায় : সম্রাট কণিষ্কের রাজত্বকালে ‘অভিধম্ম’ গ্রন্থের ‘বিভাষা’ নামে একটি ভাষ্য রচিত হয়েছিল। এ বিভাষা ভাষ্যের অনুগামীদের ‘বৈভাষিক’ নামে অভিহিত করা হয়। বৈভাষিকগণ ‘সুত্ত’কে প্রামাণ্য মনে করেন না। তাঁদের মতে, ‘অভিধৰ্ম্মই’ একমাত্র প্রামাণ্য। বৈভাষিকগণ হীনযান ধর্ম সম্প্রদায়ভূক্ত।
বৈভাষিক সম্প্রদায়ের বাহ্য-প্রত্যক্ষবাদ : সৌত্রান্তিকদের মতো বৈভাষিকগণও সর্বাস্তিবাদী এবং মন ও বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করেন। বৈভাষিকগণ বাহ্যবস্তুকে প্রত্যক্ষণগ্রাহ্য বলে স্বীকার করেন। কিন্তু সৌত্রান্তিকদের মতে বাহ্যবস্তু অনুমান সিদ্ধ। বৈভাষিকগণ বলেন, প্রত্যক্ষ করা ছাড়া আর কোন প্রমাণের সাহায্যে বাহ্যবস্তুর অস্তিত্বকে জানা যায় না। সৌত্রান্তিকগণের বিরুদ্ধে তাঁরা বলেন, বাহ্যবস্তু অনুমানসিদ্ধ নয়। তাঁদের মতে, অনুমানের একটি বিখ্যাত উদাহরণ, ধূম দেখে আমরা আগুনের অস্তিত্ব অনুমান করি। পূর্বে ধূম ও অগ্নির সম্বন্ধ প্রত্যক্ষ করি বলেই এ অনুমান সম্ভব হয়। কোন ব্যক্তি যদি কোন দিন আগুন প্রত্যক্ষ করে না থাকে তবে তার পক্ষে ধূম দেখে আগুন অনুমান করা সম্ভব নয়। সুতরাং অস্তিত্বও অনুমান করা যায় না, যদি কোন দিন বাহ্যবস্তুকে সাক্ষাৎভাবে প্রত্যক্ষ করা না য়। সৌত্রান্তিকদের মতে কোন বাহ্যবস্তু সম্পর্কে মনের যে ধারণা তাকে আমরা সাক্ষাৎভাবে জানি এবং সেই ধারণা হতে বস্তুর অস্তিত্বকে অনুমান করি। কিন্তু ঐ বস্তুকে যদি সাক্ষাৎভাবে না জানি, তবে ধারণাটি যে ঐ বস্তুর অনুলিপি বা প্রতীক তা বুঝবো কেমন করে? সুতরাং হয় আমাদের স্বীকার করে নিতে হয় যে, আমরা ধারণা ছাড়া কিছুই জানতে পারি না (বিজ্ঞানবাদ), না হয় স্বীকার করে নিতে হবে যে বাহ্যবস্তুর নিজস্ব সত্তা আছে এবং তাকে সাক্ষাৎভাবে জানা যায়। কিন্তু বিজ্ঞানবাদ অর্থাৎ আমরা ধারণা ছাড়া কিছুই জানতে পারি না, এটি ভ্রান্ত মতবাদ। সুতরাং বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব আছে এবং তার অস্তিত্বকে সাক্ষাৎভাবে জানা যায় তা মেনে নিতে হয়। এ কারণেই বৈভাষিকদের মতবাদকে বাহ্যপ্রত্যক্ষবাদ বলে । বৈভাষিক মতে বাহ্যবস্তুমাত্রেই আপেক্ষিক কার্য-কারণের অধীন। একটি উপাদানকে আশ্রয় করে অপর একটি উপাদানের উৎপত্তি হয়। অব্যবহিত পূর্ববর্তী কারণটিকে সমনন্তর প্রত্যয় বলা হয়। যে প্রত্যয়টি আশ্রয় করে অপর একটি প্রত্যয়ের সৃষ্ট হয় তাকে অধিপতি প্রত্যয় বলে। অধিপতি প্রত্যয় না ঘটলে নির্দিষ্ট কার্য উৎপন্ন হতে পারে না। বস্তুর রূপ, রস, গন্ধ, শব্দের সংবেদন এবং প্রত্যক্ষ হয়। বাহ্যবস্তু এবং এর গুণসমূহকে আশ্রয় করে সংবেদন এবং প্রত্যক্ষের সৃষ্টি হয় বলে এদেরকে আলম্বন প্রত্যয় বলে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় বৈভাষিক সম্প্রদায়ের বাহ্য-প্রত্যক্ষণবাদ অনুসারে বাহ্যবস্তুর নিজস্ব সত্তা আছে। তাইতো বৈভাষিক সম্প্রদায়ের বাহ্য-প্রত্যক্ষণবাদ বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে যেসকল ব্যাখ্যা প্রদান ক
রে তা সমগ্র ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাধারায় এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।