বৌদ্ধ দর্শনে নির্বাণ কী?

অথবা, নিৰ্বাণ বলতে গৌতম বুদ্ধ কি বুঝিয়েছেন?
অথবা, নির্বাণ কী?
অথবা, নির্বাণ বলতে বৌদ্ধ দর্শনে কী বুঝায়?
উত্তর৷ ভূমিকা :
বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি বা দুঃখ থেকে চির মুক্তিলাভকেই নির্বাণ বলা হয়েছে। বৌদ্ধ দর্শনে মোক্ষকেই নির্বাণ নামে অভিহিত করা হয়েছে। বৌদ্ধ মতে, অষ্টাঙ্গিক মার্গ যেমন- সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্ বা বাক্ সংযম, সম্যক কর্মান্ত বা সংযত আচরণ, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি এবং সম্যক
সমাধি অনুসরণ করে নির্বাণ লাভ করা সম্ভব।
নির্বাণের প্রকৃতি বা স্বরূপ : অনেকে মনে করেন নির্বাণের অর্থ আত্যন্তিক বিন্যাস বা পূর্ণ বিলুপ্তি। তাঁদের মতে, কামনা-বাসনাই জীবন এবং নির্বাণে যেহেতু কামনা-বাসনার আত্যন্তিক বিনাশ ঘটে সেহেতু জীবের সত্তারও পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে। তাঁদের মতে, নির্বাণে ভোগ তৃষ্ণার এবং ভোগ তৃষ্ণাজনিত দুঃখের একান্ত নিরোধ হয়। বৌদ্ধ দর্শনে নির্বাণ সম্পর্কে চারটি মতবাদ রয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. নির্বাণ হলো সত্তার আত্যন্তিক বিন্যাস বা অবসান : নির্বাণ কথাটির সাধারণ অর্থ নিভে যাওয়া বা দীপ নির্বাপিতnহওয়া। যিনি নির্বাণ প্রাপ্ত হন তাঁকে অনেক সময় নির্বাপিত দীপের সাথে তুলনা করা হয়। নির্বাণ কথাটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এবং নির্বাণের অভাবাত্মক বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে অনেকে নির্বাণকে সত্তার আত্যন্তিক বিন্যাস বা অবসান রূপে ব্যাখ্যা করেছেন। এ মতবাদের সমর্থকবৃন্দ মনে করেন, বুদ্ধদেব যেহেতু দ্রব্যরূপে আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন সেহেতু নির্বাণকে সত্তার আত্যন্ত্রিক
বিনাশ হিসেবে ব্যাখ্যা করাই সঙ্গত। বুদ্ধেদেবের মতে, সবকিছুই অনিত্য এবং শাশ্বত। চিরন্তন আত্মা বলে কোন কিছু নেই।
২. নির্বাণ এক শাশ্বত আনন্দের অবস্থা : কেউ কেউ মনে করেন নির্বাণ হলো এক শাশ্বত আনন্দের অবস্থা। ধর্মপদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাণং পরমং সুখম্’। সকল প্রকার কামনা-বাসনার বিলোপ সাধনে মানুষ যে শাশ্বত ও অনাবিল আনন্দের অধিকারী হয় সেই আনন্দ অবস্থাই নির্বাণ। নির্বাণ শুধু পরম আনন্দই নয়, নির্বাণ হলো পরম শান্তি।
৩. নির্বাণ হলো এক অচিন্তনীয় অবস্থা : অনেকে মনে করেন নির্বাণ হলো এক অচিন্তনীয় অবর্ণনীয় অবস্থা। এ হলো এমন একটা অবস্থা যাকে আমাদের জাগতিক অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করা চলে না। ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত নির্বাণকে অবর্ণনীয় অবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ভাবাত্মক কিংবা অভাবাত্মক কোন কিছুর দ্বারাই নির্বাণের স্বরূপ প্রকাশ করা যায় না। নির্বাণ অতীন্দ্রিয় ও অবাঙ্মানসগোচর।
৪. নির্বাণ হলো একটি শাশ্বত অপরিবর্তনীয় অবস্থা : নির্বাণ হলো একটি শাশ্বত অবস্থা। কারণ নির্বাণের উৎপত্তি নেই কাজেই বিনাশও নেই। নির্বাণ হলো এমন একটি অবস্থা যা অজাত, অভূত এবং অসংস্কৃত। নির্বাণ একটি ভাবাত্মক পদার্থ। নির্বাণের অস্তিত্ব অস্বীকার করা চলে না। কেননা অতীন্দ্রিয় অনুভূতির দ্বারা একে উপলব্ধি করা যায়। নির্বাণ হলো অসংস্কৃত ধর্ম যা অন্যকোন ধর্মের কারণ বা ফল নয়। নাগসেন তাঁর শিষ্য মিনিন্দাকে নির্বাণের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে নির্বাণকে কখনো সমুদ্র, কখনো বা পর্বতের শৃঙ্গ, কখনো মধুর মিষ্টত্বের সাথে তুলনা করেছেন। তবে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন এগুলো উপায়মাত্র এবং এদের দ্বারা নির্বাণের প্রকৃত অবস্থা হৃদয়ঙ্গম করা কখনো সম্ভব নয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, নির্বাণ সম্পর্কে বৌদ্ধ দর্শনে যে ধারণা দেয়া হয়েছে তা অনেকাংশে গ্রহণযোগ্য। এছাড়া বৌদ্ধ দর্শনে নির্বাণ লাভই হলো চরম উদ্দেশ্য।