অথবা, বৌদ্ধ দর্শনে অনিত্যবাদ বলতে কী বুঝ?
অথবা, বৌদ্ধ দর্শনে সর্বব্যাপক পরিবর্তনবাদ বলতে কি বুঝ?
অথবা, ক্ষণিকত্ববাদ সম্পর্কে বৌদ্ধ দার্শনিকদের অভিমত কী?
উত্তর৷ ভূমিকা : গৌতম বুদ্ধের বাণী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠে সে মতবাদকে ‘বৌদ্ধ দর্শন’ বা ‘বৌদ্ধ ধর্ম’ বলে। গৌতম বুদ্ধের নৈতিক শিক্ষার মূলে চারটি দার্শনিক তত্ত্ব রয়েছে। এ চারটি তত্ত্ব হলো প্রতীত্য সমুৎপাদ বা শর্তাধীন সৃষ্টিবাদ, কর্মবাদ, ক্ষণিকত্ববাদ, সর্বব্যাপক পরিবর্তনবাদ বা অনিত্যবাদ এবং অনাত্মবাদ। নিম্নে প্রশ্নপত্রের আলোকে বৌদ্ধ দর্শনের ক্ষণিকত্ববাদ বা সর্বব্যাপক পরিবর্তনবাদ বা অনিত্যবাদ আলোচনা করা হলো :
বৌদ্ধ দর্শনের ক্ষণিকত্ববাদ বা সর্বব্যাপক পরিবর্তনবাদ বা অনিত্যবাদ : বৌদ্ধিক দর্শনের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধ বলেছেন— জগতে স্থায়ী কিছু নেই, সবই অস্থায়ী। ‘সর্বম্ অনিত্যম্’। বুদ্ধদেবের অনিত্যবাদ তাঁর প্রতীত্য সমুৎপাদবাদেরই একটি রূপ যার পথ ধরে পরবর্তী বৌদ্ধ দার্শনিকগণ ক্ষণিকত্ববাদের প্রচলন করেন। বুদ্ধদেব তাঁর প্রতীত্যসমুৎপাদবাদে বলেছেন, জগৎ নিয়ত পরিবর্তনশীল। কোন বস্তু স্বল্পস্থায়ী, আবার কোন বস্তু দীর্ঘস্থায়ী। কিন্তু স্বল্পস্থায়ী হোক, দীর্ঘস্থায়ী হোক সকল বস্তুই কোন না কোন সময়ে পরিবর্তিত হবে। যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু হবেই, যার উৎপত্তি হয়েছে তার ধ্বংস অনিবার্য। তবে স্থায়িত্বের কালের হেরফের হতে পারে। এ মতবাদে বুদ্ধদেব সব বস্তুকে অনিত্য বা অস্থায়ী বলেছেন কিন্তু ক্ষণিক বলেননি। তিনি কেবল সংবিদ বা চেতনাকে ক্ষণিক বলেছেন। দেখা যায়, দেহ কখনো এক বছর আবার কখনো শত বছর থাকে। কিন্তু মন বা সংবিদ একরূপে বিনষ্ট হয়ে অন্যরূপে আবির্ভূত হচ্ছে। বুদ্ধদেব মনকে এজন্যই অগ্নিশিখার সাথে তুলনা করেছেন। অগ্নিশিখার মতো চিত্তও অনবরত পরিবর্তনশীল। কিন্তু মানসিক অবস্থার এ ক্ষণিকত্ব তিনি বাহ্যবস্তুতে আরোপ করেন নি। গৌতম বুদ্ধের এ চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করেই পরবর্তী বৌদ্ধ দার্শনিকগণ বিশেষ করে সৌত্রান্তিক বৌদ্ধগণ ক্ষণিকত্ববাদের প্রচলন করেন। মানসিক অবস্থাসমূহকে বুদ্ধদেব ক্ষণিক বলেছেন। কিন্তু অন্যান্য
পদার্থকে তিনি শুধু নিত্য বলেছেন। ক্ষণিকত্বকে সর্ববিধ পদার্থে প্রসারিত করে দেওয়ার ফলে যে মতবাদ পাওয়া যায় তা হলো ক্ষণিকত্ববাদ বা ক্ষণভঙ্গবাদ। ক্ষণিকত্ববাদ অনুসারে সবকিছুর সত্তাই ক্ষণকালের জগতের বস্তুসমূহ শুধু যে অনিত্য তা-ই নয়, প্রত্যেক বস্তুর অস্তিত্ব একটি ক্ষণের জন্য মাত্র। ‘স্থায়ী সত্তা’ একটি স্ববিরোধী কথা। শাশ্বত সত্তা বলে কিছু নেই, যা আছে তা ক্ষণিকের সত্তা। ক্ষণিকত্ববাদকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ দর্শনে দ্বিবিধ মতবাদের উদ্ভব হয়েছে । যথা :
ক. প্রাচীন বৌদ্ধ মত ও খ. নব্য বৌদ্ধ মত।
ক. প্রাচীন বৌদ্ধ মত : প্রাচীন বৌদ্ধ দার্শনিকগণের মতে, গৌতম বুদ্ধ প্রতিটি সৎ বস্তুকে ক্ষণিক বা অনিত্য মনে করতেন।
খ. নব্য বৌদ্ধ মত : ‘যা সৎ তা ক্ষণিক’ যা সৎ তা অর্থক্রিয়াকারী তাই তা ক্ষণিক- এটাই নব্য বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতামত।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বৌদ্ধ ক্ষণিকত্ববাদের মূলকথা হলো- নিত্য, অপরিবর্তনীয়, অবিনশ্বর বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। জগতের সবকিছুই পরিবর্তনশীল। আমাদের জীবন হচ্ছে এক অবিরাম প্রবাহ সৃষ্টি আর ধ্বংসের অন্তহীন স্রোত । পৃথিবীতে শাশ্বত সত্তা, নিত্য বলে কিছু নেই, আছে শুধু পরিবর্তন।