অথবা, বৌদ্ধ দর্শনে আত্মার যে সনাতনী ধারণা দেয়া হয়েছে তা সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, সনাতনী আত্মা বলতে বৌদ্ধরা কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর৷ ভূমিকা : গৌতম বুদ্ধের বাণী এবং উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠেছে সে মতবাদই বৌদ্ধ দর্শন। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধধর্মের আদর্শ ও রীতি নীতি নিয়ে বুদ্ধদেবের শিষ্যদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এ নিয়ে দ্বন্দ্বের একপর্যায়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে হীনযান এবং মহাযান
নামে দুটি পৃথক সম্প্রদায় গড়ে তোলে। বৌদ্ধ ধর্মের এ দুটি পৃথক সম্প্রদায় পরবর্তী আত্মা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে পরস্পরবিরোধী মত পোষণ করেন।
সনাতন আত্মার ধারণা : প্রাচীন বৌদ্ধ মতে, চিরন্তন, নিত্য, অক্ষয়, অব্যয় আত্মার স্থান নেই । আত্মা মানুষের চিন্তা, ভাব, ধারণা, অনুভূতি, ইচ্ছা প্রভৃতি মানসিক ক্রিয়ার প্রবাহ। মানুষের চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছার অতীত এসব মানসিক প্রক্রিয়ার আধার স্বরূপ আত্মারূপ বস্তুর স্থায়ী সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়।
মহাযানী ধারণা : সাধারণ মানুষ আত্মায় অবিশ্বাসী হতে চায় না। মহাযানীরা আত্মার ধারণার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে সে অভাব অনেকটা পূরণ করে। তাদের মতে, জীবাত্মার কোন সত্তা নেই। জীবাত্মা মিথ্যা, ভ্রম, স্বপ্ন, মরীচিকা ও অযথার্থ। এটা তুচ্ছ, ক্ষুদ্র, এর কোন নিজস্ব অস্তিত্ব নেই।
জীবাত্মা পরমাত্মার প্রকাশ : মহাযানীরা বলেন, জীবাত্মা হচ্ছে মহাত্মা বা পরমাত্মার প্রকাশ। এই পরমাত্মা এক অতীন্দ্রিয় সত্তা, সকল জীবের আত্মস্বরূপ। এই পরমাত্মা সকল জীবের মাঝে নিজেকে প্রকাশ করে। জীবাত্মা যদি পরমাত্মায় লীন হয়ে যায় তবে তার মহানির্বাণ প্রাপ্তি ঘটে বা সে নির্বাণ লাভ করে।
হীনযানী ধারণা : হীনযানীদের মতে, কোন শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব নেই তবে পরমাত্মার অস্তিত্ব আছে। তাদের মতে, জীবাত্মা পরমাত্মার প্রকাশ। হীনযানীদের মতে, আত্মমুক্তিই সকলের প্রকাশ। হীনযানীদের মতে, আত্মমুক্তিই সকলের কাম্য হওয়া উচিত যেখানে মহাযানীদের মতে, বিশ্বের সকল লোকের মুক্তিই কাম্য।
ধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষা : হীনযানীরা বৌদ্ধ ধর্মমতের কোনরকম পরিবর্তনের পক্ষপাতী নয়। তাদের মতে, যে কোন পরিবর্তনের ফলে ধর্মের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়। হীনযানীরা ধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য কঠোরতা ও কৃচ্ছ্রতা অবলম্বনের পক্ষপাতী। তাই তারা মানসিক প্রক্রিয়ার আধাররূপে ব্যক্তিগত আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আত্মার উপরোক্ত ধারণা হতে দেখা যায়, মহাযানীদের লক্ষ্য মানবিকতা ও বিশ্বজনীনতা। মুষ্টিমেয় কয়েকজনের বা একার মুক্তি নয় বিশ্বজনীন আত্মার মুক্তিই তাদের লক্ষ্য। আবার যে কোন ধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষারও দরকার আছে, যেমন তাকে উদার ও বিশ্বজনীন করে তোলার প্রয়োজন রয়েছে। এ হিসেবে এ উভয়
সম্প্রদায় পরস্পরের বিরোধী নয়; বরং পরস্পরের পরিপূরক।