অথবা, গৌতম বুদ্ধ নির্দেশিত আর্যসত্যগুলোর যে কোন একটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ‘দুঃখ নিবৃত্তির পথ আছে’ উক্তিটি বৌদ্ধ দর্শনের আলোকে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, গৌতম বুদ্ধের চতুর্থ আর্যসত্যটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : গৌতম বুদ্ধের বাণী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠেছে সে মতবাদই বৌদ্ধদর্শন। গৌতম বুদ্ধ আত্মশক্তির উপর বিশ্বাস রেখে বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষ তলে বহু বছর কঠোর তপস্যা করে জগতে দুঃখের রহস্য ও স্বরূপ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। এটাই তার বুদ্ধত্ব লাভ এবং এদিন থেকে তিনি সম্যকজ্ঞানী নামে খ্যাত হন। তিনি যেসব সত্যের জ্ঞান লাভ করেন তার সর্বশেষ সত্যটি হলো দুঃখ নিবৃত্তির পথ আছে বা মার্গ আছে ।
দুঃখ নিবৃত্তির পথ আছে : বুদ্ধদেবের চতুর্থ আর্যসত্য হল দুঃখ নিবৃত্তির পথ আছে। তাঁর মতে, দুঃখের কারণ অপসারণ করার পথই হলো দুঃখ নিবৃত্তির পথ। এই পথের আটটি স্তর আছে। তাই এই পথকে বৌদ্ধ দর্শনে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। বুদ্ধদেবের মতে, এই পথ সকলের জন্য উন্মুক্ত। ভিক্ষু-অভিক্ষু সকলেই এই একই পথ অনুসরণ করবে। দুঃখের নিবৃত্তিকামী কাহারও জন্য কোন বিশেষ পথের ব্যবস্থা নাই। এ আটটি স্তর সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. সম্যক দৃষ্টি : চারটি আর্যসত্য সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানই হলো সম্যক দৃষ্টি। বুদ্ধদেবের মতে, অবিদ্যা বা অজ্ঞানই দুঃখের মূল কারণ। এই অবিদ্যা হতেই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানুষের মিথ্যা জ্ঞান উদ্ভূত হয়।
২. সম্যক সংকল্প : পার্থিব বস্তু সম্পর্কে আসক্তি, ভোগ-বিলাস, হিংসা, রাগ ও দ্বেষ বর্জন করার দৃঢ় ইচ্ছাই সম্যক সংকল্প। বুদ্ধদেব বলেন, কেবল আর্যসত্যগুলো সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানের দ্বারা দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করা সম্ভব নয়। এজন্য জ্ঞানানুসারে কর্ম করার সংকল্পেরও দরকার আছে।
৩. সম্যক বাক : মিথ্যা কথা, কটু কথা, অসার কথা, পরনিন্দা প্রভৃতি বর্জন করাই বাক সংযমের লক্ষণ। বুদ্ধদেব বলেন, কেবল সৎ সংকল্প গ্রহণ করলে মুক্তি আসবে না, সংকল্প অনুসারে কাজও করতে হবে। এজন্য প্রথমেই দরকার বাক সংযম।
৪. সম্যক কৰ্মান্ত : অহিংসা, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, সত্য ও মাদকদ্রব্য বর্জন এই পাঁচটি আচরণ সম্যক কর্মান্তের অন্তর্গত। বুদ্ধদেব বলেন, কেবল সংযত বাক্য বললে চলবে না, সংযত আচরণেরও প্রয়োজন।
৫. সম্যক আজীব : সদুপায়ে জীবনযাত্রা নির্বাহ করাই হলো সম্যক আজীব। বুদ্ধদেব বলেন, মুক্তিকামীকে জীবিকা অর্জনের জন্য অসৎ উপায় বর্জন করতে হবে। মিথ্যা ভাষণ ও অন্যায় আচরণ বর্জন করে সদুপায়ে জীবিকা নির্বাহ করাই মুক্তিকামীর কর্তব্য।
৬. সম্যক ব্যায়াম : মনে দৃঢ়মূল কুচিন্তার বিনাশসাধন, নতুনভাবে মনে কুচিন্তার উৎপত্তি নিবারণ, মনে সৎ চিন্তা আনয়ন ও সৎ চিন্তাকে মনে সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টাই সম্যক ব্যায়াম। বুদ্ধদেব বলেন, মুক্তিকামীকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। কারণ নৈতিক জীবনে বেশ উন্নত ব্যক্তিরও পতনের আশঙ্কা থাকে।
৭. সম্যক স্মৃতি : জগৎ, শরীর, মন ও ইন্দ্রিয়াদি সবই অনিত্য, জীবন ক্ষণস্থায়ী প্রভৃতি তত্ত্বকথা সব সময় স্মরণে রাখাই সম্যক স্মৃতি। বুদ্ধদেব বলেন, মুক্তিকামীকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে কেননা দীর্ঘদিনের সংস্কারবশত মানুষের মনে আসক্তির সৃষ্টি হয়। এই আসক্তি হতে বন্ধন এবং এই বন্ধন হতে দুঃখের উদ্ভব হয়।
৮. সম্যক সমাধি : মনঃসংযোগের নামই সমাধি। সম্যক সমাধিই অষ্টমার্গের শেষ স্তর। যে ব্যক্তি পূর্বোক্ত সাতটি নীতির অধিকারী হয়েছেন। তিনিই সম্যক সমাধির মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করতে পারেন।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, গৌতম বুদ্ধ দুঃখ হতে মুক্তির যে আটটি পথের কথা বলেছেন তা জ্ঞানগত দিক থেকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধ ধর্মোপ
দেশ দেয়ার সময় বলেছেন, মুক্তিকামীকে অবশ্যই দুটি পথ বর্জন করতে হবে। এ দুটি পথ হলো- (i) অতিরিক্ত ভোগবিলাস এবং কামনা-বাসনার পথ, (ii) অতিরিক্ত আত্মনিগ্রহ ও নিরানন্দের
পথ । আতিশয্যের দুটি পথ বর্জন করে তিনি এগুলোর মধ্যবর্তী পথ অনুসরণ করার পরামর্শ দেন।