অথবা, বৌদ্ধ মহাযান সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বৌদ্ধ দর্শনের মহাযান শাখার নতুন ভাব বা তথ্য সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় জগৎ এবং জীবন সম্পর্কীয় যে কোন ধরনের সমস্যার উদ্ভব হলে বুদ্ধ তাঁর অপরিসীম বিচক্ষণতার দ্বারা খুব সহজেই সেগুলোর সমাধান দিতেন। বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর বৌদ্ধধর্মের আদর্শ ও রীতিনীতি নিয়ে বুদ্ধদেবের শিষ্যবর্গের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছিল। এই মতভেদ দূর করার জন্য বৈশালীতে বৌদ্ধগণের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেই সম্মেলন সফল না হওয়ায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। প্রাচীনপন্থি গোঁড়া বৌদ্ধগণ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পালনীয় আচার ব্যবহারের কঠোরতা শিথিল করার পক্ষপাতি ছিলেন না। যে সকল এই মতের বিরোধিতা করলেন তাদেরকে প্রাচীনপন্থীরা সংঘ থেকে বের করে দেন। ফলে হীনযান ও মহাযান নামে পৃথক দুটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়।
মহাযান নামকরণ : প্রাচীনপন্থিদের মতের বিরোধিতা করায় বহিষ্কৃত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সম্মিলিত হয়ে প্রথমে মহাসঙ্গিক নামে একটি সম্প্রদায় গঠন করে। এ সম্প্রদায় কালক্রমে মহাযান সম্প্রদায় নামে পরিচিতি লাভ করে।
উদারতাবাদী মনোভাব : মহাযান ধর্ম সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয় সম্রাট অশোক এবং কনিষ্কের মধ্যবর্তী সময়ে। কালক্রমে এ সম্প্রদায় খুবই প্রসার লাভ করে এবং এই প্রসার লাভের অন্যতম কারণ হলো মহাযানপন্থীদের মানবতা এবং উদারতাবাদী মনোভাব। তারা মানবিক দিককে সবকিছুর উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন।
গৌড়া ও রক্ষণশীল নয় : মহাযান সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মানুষের পালনীয় আচার ব্যবহারে কঠোরতার পক্ষপাতি ছিলেন না। তারা হীনযানীদের মতো গোঁড়া ও রক্ষণশীল নয়। তাদের বক্তব্য হলো, সমস্ত মানুষের মুক্তিই যখন লক্ষ্য, তখন সমাজ ত্যাগ করে একান্তে কঠোর কৃচ্ছসাধনের কোন দরকার নেই।
সর্বজীবের মুক্তি কামনা : মহাযানপন্থিরা বলেন, কেবল নিজের মুক্তি কারো লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। কারণ কেবল নিজের মুক্তির চেষ্টা করা এক রকম স্বার্থপরতা। প্রকৃত বৌদ্ধের কর্তব্য হবে সারা বিশ্বের কল্যাণসাধন করা। বুদ্ধদেব সর্বজীবে দয়া করার উপদেশ দিতেন। বুদ্ধদেবের এই উপদেশকেই মহাযানপন্থিরা প্রাধান্য দিতেন।
মহাযান সম্প্রদায়ের লক্ষ্য : বিশ্বপ্রেম এবং বিশ্বকল্যাণই মহাযান সম্প্রদায়ের চরম লক্ষ্য। তাদের পথ কেবল একার জন্য নয়, সকল মানুষের জন্য। তারা সেই পথের কথা বলেছেন, যে পথের অনুসরণ করে সবাই মুক্তি লাভ করতে পারে। অর্থাৎ মহাযান সম্প্রদায়ের লক্ষ্য ছিল সার্বজনীন মুক্তির পথ অনুসন্ধান ।
হীনযানীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ : মহাযানপন্থিরা হীনযানীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেন যে, হীনযানীরা বুদ্ধদেবের উপদেশকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেছেন। তারা বুদ্ধের উপদেশের তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করেন নি। সকল মানুষের মুক্তিই যে বুদ্ধদেবের কাম্য ছিল এর প্রমাণ স্বয়ং বুদ্ধদেবের জীবনদর্শন হতেই পাওয়া যায়।
মহাযানদের দার্শনিক তত্ত্ব : দার্শনিক তত্ত্বের দিক থেকে বিচার করে দেখলে মহাযানপন্থিদের ভাববাদের সমর্থন বলা যায়। মাধ্যমিক ও যোগাচার দার্শনিক সম্প্রদায় মহাযান ধর্ম সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।
উত্তর দেশীয় বৌদ্ধমত: গৌতম বুদ্ধের প্রবর্তিত মত চতুর্দিকেই বিস্তার লাভ করেছিল। তিব্বত, চীন, জাপান, কোরিয়া প্রভৃতি উত্তর দেশে মহাযান সম্প্রদায়ের বিস্তার হয়েছিল বলে মহাযান ধর্মমতকে উত্তর দেশীয় বৌদ্ধমত নামেও অভিহিত করা হয়।
মহাযান শাখার নতুন ভাব বা তথ্য : মহাযানপন্থিরা বৌদ্ধধর্মে বেশকিছু নতুন ধারণা বা নতুন ভাবের সমন্বয় ঘটান। বৌদ্ধধর্মের মহাযান শাখায় যেসব নতুন ভাব ও তথ্য প
াওয়া যায় সেগুলো হলো: (i) বোধিসত্ত্বের আদর্শ, (ii) বুদ্ধদেবই ঈশ্বর এবং (iii) আত্মার পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
বোধিসত্ত্বের অর্থ : ‘বোধি’ শব্দের অর্থ প্রজ্ঞা বা পরম জ্ঞান, অর্থাৎ যে জ্ঞানের দ্বারা সাধক কেবল নিজের মুক্তিলাভের চেষ্টা না করে বিশ্বের সর্বলোকের মুক্তির চেষ্টা করেন তাই বোধিজ্ঞান। আর বোধিসত্ত্ব বলতে সাধারণত তাকেই বুঝায় যিনি বোধি বা পরম জ্ঞানলাভের পথে উপনীত হতে চলেছেন। বুদ্ধদেবের বুদ্ধত্বলাভের অব্যবহিত পূর্ব অবস্থায় তাঁকে বোধিসত্ত্ব বলা হয়েছিল ।
বোধিসত্ত্বের আদর্শ : বোধিসত্ত্বের আদর্শ হলো পরম জ্ঞান লাভ করা এবং এই জ্ঞানের দ্বারা দুঃখ জর্জরিত সকল মানুষকে দুঃখ হতে মুক্তিলাভের জন্য সাহায্য করা। বোধিসত্ত্বরা নিজেদেরকে অর্জিত জ্ঞানের শিক্ষা দিয়ে মানুষকে মুক্তির পথ দেখান।
প্রজ্ঞা ও করুণার সমাবেশ : বোধিসত্ত্বের জীবনে প্রজ্ঞা ও করুণার সমাবেশ দেখা যায়। বোধিসত্ত্বরা অপরাপর ব্যক্তিদের দুঃখের হাত হতে মুক্ত করার জন্য বারংবার জন্ম-মৃত্যুর অধীন হলেও সংসারের পাপ ও কামনা-বাসনা তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না। যেমন, পদ্মের জন্ম পঙ্কিলে হলেও পঙ্কিল পদ্মকে স্পর্শ করতে বা কলুষিত করতে পারে না।
কর্মফল বিনিময় : বোধিসত্ত্বরা নিজের সৎকর্মের ফলাফল দুঃখতাপিত জনগণের কর্মফলের সঙ্গে বিনিময় করে তাদের দুঃখ নিজেরাই ভোগ করেন। ফলে দুঃখপীড়িত জনগণ দুঃখভোগ হতে অব্যাহতি পায়। বোধিসত্ত্বের অবস্থা লাভই মহাযানপন্থিদের জীবনের ব্রত ও আদর্শ।
ঈশ্বরের ধারণা : হীনযান ধর্মসম্প্রদায়ের ঈশ্বরবিহীন আত্ম-নির্ভরতার ধর্ম সাধারণ লোকের মনকে জয় করতে পারে না। সাধারণ মানুষ খুবই দুর্বল। আপদে-বিপদে আত্মার ক্ষয় সাধনে যখন সে ব্যর্থ হয়, তখন সে নিজেকে খুব অসহায় মনে করে। এই অসহায় অবস্থায় সে চায় এক প্রেমময় পুরুষের দয়া ও আশ্রয়। এই প্রেমময় পুরুষই ঈশ্বর।
বুদ্ধদেবই ঈশ্বর : সাধারণ মানুষ এমন ধর্ম চায়, যে ধর্ম ক্ষমাসিন্ধু করুণাময় পতিতপাবন ঈশ্বরের স্বীকৃতি আছে। মহাযান সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুর এই নিগূঢ় সত্য উপলব্ধি করেন এবং সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা মেটাতে সচেষ্ট হন। তাই তাঁরা বলেন, এই বুদ্ধদেবই হচ্ছেন ঈশ্বর। তিনিই পাপী-তাপীর ত্রাণকর্তা।
পরম সত্তার প্রকাশ : মহাযানপন্থিরা তাদের কথার সমর্থনে আরও বলেন, এক পরম সত্তা আছেন, যিনি বেদান্তের নির্গুণ ব্রহ্মের মত অতীন্দ্রিয় এবং বর্ণনাতীত। ধর্মকায়রূপে তিনি জগতে আত্মপ্রকাশ করে জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং বিশ্বের মানুষকে দুঃখ হতে পরিত্রাণ লাভে সহায়তা করেন। বুদ্ধদেব সেই পরম সত্তারই প্রকাশ অর্থাৎ সেই পরম সত্তারই
অবতার । সেই পরম সত্তা বুদ্ধদেবের মত আরও বহুবার অবতীর্ণ হয়েছেন বলে মহাযানরা মনে করেন।
বুদ্ধদেব ঈশ্বরের স্থলাভিষিক্ত : মহাযানপন্থিরা ধর্মকায়রূপে বুদ্ধদেবকে ঈশ্বর বা ভগবানের আসনে উপবিষ্ট করে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেছেন। তাদের মতে, বুদ্ধদেব ঈশ্বরের স্থলাভিষিক্ত। সাধারণ মানুষ ঈশ্বরের পূজার মতো বুদ্ধদেবেরও পূজা-অর্চনা করতে পারে এবং তাঁর করুণা ও সাহায্যপ্রার্থী হতে পারে।
আত্মার নিত্যতা : বৌদ্ধধর্মের প্রাচীনপন্থিরা নিত্য আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন। তাঁদের মতে, আত্মা হলো চিন্তা, অনুভূতি প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়ার প্রবাহ মাত্র। কিন্তু সাধারণ মানুষ এই জাতীয় আত্মায় সন্তুষ্ট নয়। তাদের বিশ্বাস, চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়ার আঁধারস্বরূপ নিত্য আত্মা বলে কোন এক বস্তু আছে। সাধারণ মানুষের যুক্তি হলো, নিত্য আত্মা বলে যদি কিছু না থাকে তবে মানুষ কার মুক্তির জন্য সাধনা করবে?
নিত্য আত্মার পুনঃপ্রতিষ্ঠা : মহাযানপন্থিরা নিত্য আত্মার ধারণ
ার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে সাধারণ মানুষের সংশয় দূর করেন। তাঁরা বলেন, ব্যক্তি আত্মার কোন সত্তা নেই। কিন্তু পরম আত্মার সত্তা আছে। এই ব্যক্তি আত্মা পরমাত্মারই বহিঃপ্রকাশ। এই পরমাত্মা সকল ব্যক্তি আত্মার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় এবং এটা নিত্য। ব্যক্তি আত্মা যখন পরমাত্মায়
বিলীন হয়ে যায়, তখনই মানুষের মহানির্বাণ ঘটে।
উপসংহার : পরিশেষে আমার বলতে পারি যে, গৌতম বুদ্ধের বাণী এবং উপদেশের যথার্থ তাৎপর্য উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে মানবজীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধানের পথ নির্দেশ করায় মহাযান সম্প্রদায় দার্শনিক চিন্তার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন। তারা বৌদ্ধধর্মের নিয়মকানুন পালনে ততটা কঠোরতার পক্ষপাতী ছিলেন না।
তাই প্রাচীনপন্থি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। কিন্তু তারপরও তারা তাদের জীবনমুখী চিন্তাচেতনার দ্বারা ধর্মের প্রগতিশীল ধারাকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যান। তারা তৎকালীন সময়ের বাস্তবতার উপযোগিতার দিকে লক্ষ্য রেখে নতুন কিছু তত্ত্বও প্রদান করেন। তাই তাদের মতবাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যায় এবং তাদের মতের ধারা খুব দ্রুত প্রসার লাভ করে।