অথবা, বৌদ্ধ দর্শনের বৈশিষ্ট্যগত দিক সম্পর্কে
ব্যাধি এবং সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে হিমালয়ের পাদদেশে কপিলাবস্তু নগরে এক রাজপরিবারে গৌতম বুদ্ধের জন্ম। রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি বাল্যকাল থেকে চিন্তাশীল ও বৈরাগ্যভাবাপন্ন ছিলেন। জ্বরা, মৃত্যুর দুঃখাবহ দৃশ্য দেখে তিনি উপলব্ধি করেন যে, এ জগৎ দুঃখে পরিপূর্ণ। গৌতম বুদ্ধের বাণী এবং উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে যে মতবাদের উদ্ভব হয় তাকেই বলে বৌদ্ধ দর্শন। নিম্নে বৌদ্ধ দর্শনের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো :
১. প্রকৃতিবাদী : বৌদ্ধ দর্শন প্রকৃতিবাদী। এই দর্শন অনুসারে যা প্রত্যক্ষের বিষয় তাই সত্য। বুদ্ধদেব এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও পরিদৃশ্যমান জগতের উপর তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিলেন। তিনি কোন অতীন্দ্রিয় জগতের দিকে তাকান নি।
২. অভিজ্ঞতাবাদী : বৌদ্ধ দর্শন অভিজ্ঞতাবাদী। কারণ বুদ্ধদেব অভিজ্ঞতাকেই জ্ঞানের উৎস বলে মনে করতেন। তিনি সাধনার মাধ্যমে যে চরম সত্যের জ্ঞান লাভ করেছিলেন তা অভিজ্ঞতালব্ধ।
৩. অবভাসবাদী : বৌদ্ধ দর্শনকে অবভাসবাদী বলা চলে। কারণ এই দর্শন অনুসারে জগতের পরিদৃশ্যমান ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপকেই কেবলমাত্র যথাযথভাবে জানা যায়।
৪. মানবতাবাদী : বৌদ্ধ দর্শনের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানুষ। বুদ্ধদেব মানুষের ধর্মের কথাই বলেছেন। বৌদ্ধধর্ম আসলে মানবকেন্দ্রিক ধর্ম। বুদ্ধির মুক্তি ঘোষণা করেই বৌদ্ধধর্মের জন্ম। বুদ্ধদেবের কথা হচ্ছে মোহই বন্ধন আর যুক্তিতেই মুক্তি। কাজেই বৌদ্ধদর্শন হচ্ছে মানবতাবাদী দর্শন।
৫. নীতিভিত্তিক : বৌদ্ধ দর্শন নীতিভিত্তিক দর্শন। মানুষের নৈতিক অগ্রগতি সাধন করে জীবনকে দুঃখ বিমুক্ত করাই বুদ্ধের নৈতিক উপদেশ ও শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য ছিল, বুদ্ধদেব পরাতত্ত্ব সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর নৈতিক শিক্ষার মধ্যেই তার দার্শনিক চিন্তাভাবনার বীজ সুপ্ত ছিল।
৬. প্রয়োজনবাদী : বৌদ্ধ দর্শন প্রয়োজনবাদী। প্রয়োজনবাদী অনুসারে সেই ধারণা, চিন্তা-চেতনা, যুক্তি এবং ভাবনা সত্য যা আমাদের জীবনে প্রয়োজন মেটায়। বুদ্ধদেব মানুষকে দুঃখ বিমুক্ত করার ব্রতে সারাজীবন নৈতিক ও ধর্মীয় উপদেশ প্রচার করেন। তিনি মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিকের অগ্রগতির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে চিন্তাচেতনার কথা বলেছেন।
৭. মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী : বৌদ্ধ দর্শন মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী। বুদ্ধদেব বলেন, মুক্তিকামী মানুষকে আতিশয্যের দুটি চরম পথ পরিহার করতে হবে। অতিরিক্ত কামনা-বাসনা ও ভোগবিলাসের পথ এবং অতিরিক্ত আত্মনিগ্রহ ও নিরানন্দের পথ উভয়ই ত্যাগ করে মধ্যপথ অবলম্বন করতে হবে।
৮. অনাত্মবাদে বিশ্বাসী : বৌদ্ধ দর্শন অনিত্য ও অনাত্মবাদে বিশ্বাসী। বুদ্ধদেব বলেন, সবই পরিবর্তনশীল, ধ্বংসশীল ও অনিত্য। আপাতদৃষ্টিতে কোন কিছু স্থায়ী বলে মনে হলেও আসলে সবকিছুরই বিনাশ আছে। যেখানে জন্ম, সেখানে মৃত্যু, এ নিয়ম অলঙ্ঘনীয়।
৯. কর্মবাদে বিশ্বাসী : বৌদ্ধ দর্শন কর্মবাদে বিশ্বাস করে। মানুষ যেমন কর্ম করবে তেমনি ফল ভোগ করবে। এই কর্মবিধি অলঙ্ঘনীয়। বুদ্ধদেবের মতে, কর্মবাদ কার্যকারণবাদ থেকে নিঃসৃত। তাঁর মতে, কর্ম ও তার ফলের মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধ আছে।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, বৌদ্ধ দর্শনের উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর আলোকে দেখা যায় বৌদ্ধ দর্শন সত্যিই অনন্য স্থানের অধিকারী। অতীন্দ্রিয় জগৎ সম্পর্কের আলোচনায় বুদ্ধদেব নীরবতা পালন করতেন। বৌদ্ধ দর্শন মূলত দুঃখবাদী হলেও পরিণামে আশাবাদই ব্যক্ত করে। কারণ বুদ্ধদেব কেবল দুঃখের ছবি এঁকেই ক্ষান্ত হন নি, তিনি দুঃখ থেকে নিষ্কৃতিলাভের পথ নির্দেশনাও প
্রদান করেছেন।