বৌদ্ধধর্মে হীনযান সম্প্রদায় বলতে কী বুঝ?

অথবা, হীনযান সম্প্রদায়ের পরিচয় দাও।
অথবা, হীনযান সম্প্রদায় কারা?
উত্তর৷ ভূমিকা :
গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধধর্মের আদর্শ ও রীতিনীতি নিয়ে বুদ্ধদেবের শিষ্যবর্গের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। প্রাচীন পন্থি গোঁড়া বৌদ্ধগণ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পালনীয় আচারব্যবহারের কঠোরতা শিথিল করার পক্ষপাতী ছিলেন না এবং যেসব ভিক্ষু এ মতের বিরোধিতা করলেন তাদের সঙ্গ হতে বের করে দিন। বহিষ্কৃত ভিক্ষুগণ সম্মিলিত হয়ে ‘মহাসঙ্গিক’ নামে একটি সম্প্রদায় গঠন করেন। এ সম্প্রদায় কালক্রমে ‘মহাযান’ সম্প্রদায় নামে পরিচিত হয়। আর গোঁড়া প্রাচীনপন্থিদের যে সম্প্রদায় তা ‘হীনযান’ নামে পরিচিত হয়। নিচে প্রশ্নপত্রের আলোকে হীনযান সম্প্রদায়
সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো :
হীনযান সম্প্রদায় (Hinajana School) : হীনযান সম্প্রদায়ভুক্ত বৌদ্ধগণ অত্যন্ত গোঁড়া ও রক্ষণশীল। তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না; কিন্তু কর্ম নিয়মে সম্পূর্ণ আস্থাবান। তারা বিশ্বাস করেন, নিজের কর্মফল প্রত্যেককেই ভোগ করতে হবে এবং যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন ফল ভোগ করবে। ইহজন্মে যদি নিজ কর্মের ফল ভোগ করা শেষ
না হয়, তাকে পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে হবে। হীনযানপন্থিরা মনে করেন ধর্মোপদেশ, নীতি ও বাণী যথাযথ অনুসরণ করাই বৌদ্ধের একমাত্র কর্তব্য। তারা কামনা-বাসনা ও ভোগতৃষ্ণা বর্জন করে নৈতিক সূচিতা ও অন্তরে পবিত্রতা সহকারে সংযত জীবনযাপন করার উপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করেন। কারণ নির্বাণ লাভের জন্য এ জাতীয় জীবনযাত্রার নিতান্ত প্রয়োজন। হীনযানপন্থিরা আরো বলেন যে, নির্বাণ লাভের জন্য ঈশ্বর বা কোন অলৌকিক শক্তির উপর নির্ভর করতে হয় না। তারা
সকলকে এ উপদেশ দিয়ে থাকেন যে, ধর্ম-বিষয়ে বা নির্বাণ লাভের প্রচেষ্টায় প্রত্যেককে স্বাবলম্বী হতে হবে; তবে সাধারণ লোকের পক্ষে স্বাবলম্বনের পথ অনুসরণ করা কঠিন কাজ। তাই হীনযানকে শক্তিমানের এবং বীরের পথ বলা হয়। প্রত্যেক বদ্ধ জীব নিজের চেষ্টায় যে নির্বাণ লাভে সক্ষম বুদ্ধদেবের নিজের জীবনই তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। বুদ্ধদেব বলতেন “আত্মদীপোভব” অর্থাৎ নিজেকে নিজে আলো দেখাও, নিজের মুক্তির পথ নিজেই অনুসন্ধান কর, অপরের সাহায্যের আশা কর না। বুদ্ধদেব দেহত্যাগের পূর্বে শেষ কথা বলেছিলেন, “সাবয়ব দ্রব্য মাত্রই ধ্বংসশীল। অধ্যবসায়ের সাথে নিজের মুক্তি সাধন কর।” বুদ্ধদেবের নির্দেশিত পথে নিষ্ঠার সাথে চলার জন্য বৌদ্ধ সাধকেরা ‘ত্রিশরণ’ গ্রহণ করেন। তাঁরা বলেছেন, বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধম্মং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি । হীনযানপন্থিরা নির্বাণ লাভের জন্য লোকালয়ের বাইরে নির্জন স্থানে ধ্যান করার পক্ষপাতী। কারণ সামাজিক জীবনযাপনে মায়ামমতায় আবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং এর পরিণাম দুঃখ। জাগতিক সৌন্দর্য যাতে মনকে আকৃষ্ট করতে না পারে সেজন্য চলার পথে চোখ বুজে না থাকায় তারা পক্ষপাতী।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, হীনযান সম্প্রদায় বৌদ্ধধর্মের নীতি, বাণী ও ধর্মোপদেশ সম্পর্কে যে মতামত ব্যাখ্যা করেন তা বৌদ্ধধর্মকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করেছে।