অথবা, বৌদ্ধ দর্শনানুসারে বোধিসত্ত্বের আদর্শ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ‘বোধিসত্ত্বের আদর্শ মহাযান সম্প্রদায়ের দার্শনিক মত’ –উক্তিটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : গৌতম বুদ্ধের বাণী এবং উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠেছে সে মতবাদই বৌদ্ধদর্শন। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধদর্শনের আদর্শ ও রীতিনীতি নিয়ে বুদ্ধদেবের শিষ্যদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। এ নিয়ে দ্বন্দ্বের এক পর্যায়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে হীনযান ও মহাযান নামে পৃথক দুটি সম্প্রদায় গড়ে তোলে। বোধিসত্ত্বের আদর্শ মহাযান সম্প্রদায়ের একটি দার্শনিক মতবাদ ।
বোধিসত্ত্ব : ‘বোধি’ শব্দের অর্থ প্রজ্ঞা বা পরম জ্ঞান। যে জ্ঞানের দ্বারা সাধক কেবল নিজের মুক্তিলাভের চেষ্টা না করে বিশ্বের সর্বলোকের মুক্তির চেষ্টা করেন তাই পরম জ্ঞান। আর বোধিসত্ত্ব বলতে সাধারণত তাকেই বুঝায় যিনি বোধি বা পরম জ্ঞানলাভের পথে উপনীত হতে চলেছেন। বুদ্ধদেবের বুদ্ধত্বলাভের অব্যবহিত পূর্ব অবস্থায় তাঁকে ‘বোধিসত্ত্ব’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
বোধিসত্ত্বের আদর্শ : বোধিসত্ত্বের আদর্শ হল পরম জ্ঞান লাভ করা এবং সেই জ্ঞানের দ্বারা দুঃখ-জর্জরিত সকল মানুষকে দুঃখ হতে মুক্তি লাভের জন্য সাহায্য করা। বোধিসত্ত্বের জীবনে প্রজ্ঞা ও করুণার সমাবেশ দেখা যায়।
বোধিসত্ত্বার কুণ্ঠিত হন না: বোধিসত্ত্বরা অপরাপর ব্যক্তিদের দুঃখের হাত হতে মুক্ত করার জন্য বারংবার জন্ম-মৃত্যুর অধীন হতেও কুণ্ঠবোধ করেন না। তবে বার বার জন্ম-মৃত্যুর অধীন হলেও সংসারের পাপ ও কামনা-বাসনা তাদের স্পর্শ করতে পারে না। যেমন- পদ্মের জন্ম পঙ্কিলে হলেও পঙ্কিল পদ্মকে কলুষিত করতে পারে না।
কর্মফল বিনিময় : বোধিসত্ত্বরা নিজের সৎকর্মের ফলাফল দুঃখতাপিত জনগণের কর্মফলের সাথে বিনিময় করে তাদের দুঃখ নিজেরাই ভোগ করেন। ফলে দুঃখ-পীড়িত জনগণ দুঃখভোগ হতে অব্যাহতি পায়। বোধিসত্ত্বের অবস্থা লাভই মহাযানপন্থীদের জীবনের ব্রত ও আদর্শ।
বোধিসত্ত্বের আদর্শের মূলকথা : বোধিসত্ত্বেরা জগতে থেকেও জাগতিক ক্লেদে ক্লিন্ন হন না। আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হয়েও তাদের চিত্ত সব রকমের আকর্ষণ ও পাপ থেকে মুক্ত থাকে। বোধিসত্ত্বেরা মহাকরুণা চিত্ত এবং সমস্ত দুঃখার্ত প্রাণীরা তাদের করুণার পাত্র।
মহাযান সম্প্রদায়ের দর্শন : বোধিসত্ত্বের আদর্শ মহাযান সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট দার্শনিক অভিমত। মহাযান দর্শনে বলা হয়েছে, সমস্ত ব্যক্তিই ব্যক্তি হিসেবে আত্যন্তিক সত্তাহীন। এরা এক আত্যন্তিক সত্তার আংশিক বা ভ্রান্ত প্রকাশ। এই দর্শন ব্যক্তির আত্মা বা হীনাত্মা বর্জন করে মহাত্মা বা পরমাত্মাকেই মানুষের প্রকৃত আত্মা বলে গ্রহণ করে।
সর্বাঙ্গীণ মুক্তির আদর্শ : সমস্ত আত্মার স্বরূপগত ঐক্যের ভিত্তিতে মহাযানপন্থিরা শুধু নিজের মুক্তি নয়; বরং সকলের মুক্তি আধ্যাত্মিক জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মহাযান দর্শনে আরও বলা হয়েছে যে, আত্যন্তিক সত্তা তার বিভিন্ন প্রকাশের মধ্যেই বর্তমান। সেজন্য তারা বলেন, এ জগতে থেকেই নির্বাণ লাভ সম্ভব।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, বৌদ্ধ দর্শনের মহাযান সম্প্রদায় বোধিসত্ত্বের আদর্শ বলতে পরম জ্ঞানের অধিকারী হওয়াকে বুঝিয়েছেন। এ পরম জ্ঞানের অধিকারী হলে মানুষ শুধু নিজের মুক্তির কথা না ভেবে সকল জীবের মুক্তিকে জীবনের আদর্শ বলে মনে করে। এ পরম প্রজ্ঞা লাভ করে দুঃখদীর্ণ মানুষের মধ্যে থেকেই এদের দুঃখ নিবৃত্তির ব্যবস্থা করা মহাযানপন্থিদের জীবনাদর্শ।