বেগম রোকেয়ার সময়ে মুসলিম নারীসমাজে শিক্ষার অবস্থা বর্ণনা কর।

অথবা, বেগম রোকেয়ার সমসাময়িককালে নারী শিক্ষার অবস্থা কেমন ছিল?
উত্তর।৷ ভূমিকা :
বেগম রোকেয়ার জন্মলগ্ন ছিল এক অন্ধকার যুগ। কুসংস্কার, গোঁড়ামি, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, নারীসমাজের প্রতি চরম অবহেলা, অবমাননা ও লাঞ্ছনা এ ছিল তৎকালীন সমাজের বৈশিষ্ট্য। অশিক্ষা, কুশিক্ষায় সমাজ ভরে গিয়েছিল। নারী সে যুগে ছিল ঘরে বন্দি। মুসলিম সমাজে মেয়েদের ন্যূনতম শিক্ষার কোন সুযোগ ছিল না। উপরন্তু পর্দা প্রথার নামে কঠোর অবরোধ প্রথা চালু ছিল। সেকালে শুধু পুরুষ মানুষ নয়, মেয়ে মানুষের সামনেও পর্দা পড়তে হতো। তৎকালীন সমাজে নারীদের পুতুলের মত মনে করা হতো। তাদের যা বলা হবে তাই তারা করতে বাধ্য।নারীদের নিজস্ব সত্তা বলতে কিছু নেই। তাদের অধিকার, মূল্যবোধ এগুলোর কথা কল্পনাই করা যায় না। এককথায়,নারীর মনুষ্যত্ব ছিল বিকৃতরূপে।
তৎকালীন মুসলিম সমাজে নারী শিক্ষার অবস্থা : রোকেয়ার জন্মলগ্ন যে এক অন্ধকার বিভীষিকার যুগ ছিল তা অতি স্পষ্ট। এ যুগে নারীর অবস্থান সমাজে খুবই করুণ। তারা যে মানুষ অনেকক্ষেত্রে তাই ভাবতে কষ্ট হয়। মুসলিম সমাজে যে পর্দা প্রথা ছিল তা কার্যত চালু ছিল অমানবিক অবরোধ প্রথা। নারী ছিল প্রকারান্তরে গৃহবন্দিনী। পবিত্র কুরআন শরীফে নির্দেশিত পর্দা প্রথার সঙ্গে ব্রিটিশ-ভারত তথা বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের প্রচলিত অবরোধ ব্যবস্থার কোন সম্পর্ক ছিল না। কঠোর অবরোধ থাকার দরুন শুধু শিক্ষা থেকেই নয়; জীবনের বহু বিচিত্র দিক যেমন- স্বাস্থ্য এবং মনের প্রফুল্লতা ও স্বাচ্ছন্দ্য বিকাশ থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছিল। এককথায়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে অবরোধ প্রথার অভিশাপে মুসলমান নারীসমাজের স্বাধীন বিকাশের সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। নারী ছিল সমাজের বোঝাস্বরূপ।বেগম রোকেয়ার আবির্ভাবকালে মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার আলো দান করার গুরুত্ব পুরুষ সমাজ উপলব্ধি করতে পারে নি। সে সময়ে লেখাপড়া মুসলমান সমাজের এক সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অভিজাত মুসলমান পরিবারের মেয়েদের জন্য ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানদানের জন্য আরবি ভাষা শিক্ষা নয়, শুধু কুরআন পাঠ করানোর ব্যবস্থা ছিল। টিয়া পাখির মুখস্থ বুলির মত তারা পবিত্র কুরআন শরীফের আয়াত উচ্চারণ করত। এর অর্থ তাদের শেখানোর কোন ব্যবস্থা ছিল না।অভিজাত মুসলমান পরিবারের মেয়েদের বাংলা কিংবা ইংরেজি বর্ণ পরিচয়টুকুও শেখানো সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল।মেয়েদের লেখাপড়া শেখার প্রচেষ্টাকে বিদ্রূপ করে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা বলতেন, লেখাপড়া শিখিয়া মেয়ে জর্জ-ম্যাজিস্ট্রেট হবে? সে সময়ে স্ত্রী শিক্ষাবিরোধী মনোভাব নারী শিক্ষাকে অনেকাংশে পিছিয়ে দিয়েছিল। পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা পুরুষের দাস এরকম একটি মানসিকতা বিরাজ করত, যা তাদের শিক্ষার প্রধান অন্তরায়। নারীরা অনেক সুযোগ সুবিধা সমাজ তথা পরিবার থেকে পায় নি একথা সত্য কিন্তু শুধু যে সুযোগের অভাবে তারা শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিল তা নয়, সে সাথে তাদের দাসীসুলভ মনোভাব বিশেষভাবে নারীর মানসিক দাসত্ব, স্বাবলম্বন ও সমাজে যথাযোগ্য ভূমিকা গ্রহণের সাহসের প্রভাবও তাদের অধঃপতনের জন্য দায়ী। সে সময়ে নারীসমাজের দুরবস্থা ও অধঃপতনের কারণ সঠিকভাবে চিহ্নিত করে বেগম রোকেয়া বলেছেন, আত্মনির্ভরতা ছেড়ে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বামীদের নিতান্ত মুখাপেক্ষী হওয়ায় বিপদসঙ্কুল সৎআচরণ সর্বদা সুরক্ষিত থাকায় নারী সাহস, ভরসা, বল একেবারে হারিয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, “এ দারুণ শোচনীয় অবস্থা চিন্তা করার শক্তি নারীর নেই।” নারীর ভীরুতার চিত্রের পাশাপাশি শারীরিক দুর্বলতার চিত্রেরও উল্লেখ করেছেন তিনি। নারীর দুরবস্থায় দুঃখ প্রকাশ করে রোকেয়া বলেছেন, কোন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করার শক্তিটুকু তাদের নেই। নারী শিক ্ষায় পশ্চাৎপদতা ও অবনত অবস্থার জন্য শুধু যদি পুরুষ সমাজকে দায়ী করা হয়,তাহলে তা ভুল। পুরুষ বিদ্বেষ ও ঘৃণার বশবর্তী হয়ে নয়, বরং ইতিহাস চেতনার আলোকে নারীর অবনত অবস্থার পর্যালোচনা করে দেখা যায় সে সময়ে উপযুক্ত স্কুল, কলেজ এক প্রকার ছিলই না। তাছাড়া তাদের অবনত অবস্থা তথা অধঃগতির মূল কারণ শিক্ষা গ্রহণে নারীর অনাগ্রহ, শিক্ষাহীনতা, উপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব, অসচেতনতা, নিষ্ক্রিয়তা,দায়িত্বহীনতা ও মানসিক শক্তির অভাব। বেগম রোকেয়া নারীসমাজের এ অধঃপতিত অবস্থা দেখে এর মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে শিক্ষাবিস্তারকেই উল্লেখ করেছেন।
পর্যালোচনা : যুগ যুগ ধরে মুসলিম সমাজের যে কুসংস্কার ও অবনতির কারণসমূহ পুঞ্জীভূত হয়ে প্রগতির পথ রুদ্ধ করেছিল, তা একমাত্র শিক্ষা প্রচারের দ্বারাই দূর করা সম্ভব। একথা নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতই ছিল সত্য যে, তৎকালীন মুসলমান নারীসমাজের অবস্থা দেখে বেগম রোকেয়ার মনে এ মহতি চিন্তার উদয় হয়েছিল। বেগম রোকেয়া তাঁর সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতায় এ সত্যও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি কোনক্রমেই সম্ভব নয়। দেশের বিপুল জনসমষ্টির অর্ধেক নারী। এ বিপুল জনসমষ্টিকে অশিক্ষা ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে রেখে জাতির উন্নতি সাধন অলীক কল্পনামাত্র।সমাজের উন্নতি সাধনের জন্য শুধু পুরুষ সম্প্রদায় নয়, নারী সম্প্রদায়েরও উন্নতি সাধন প্রয়োজন। একই সমাজদেহের দুই অপরিহার্য অঙ্গ নারী ও পুরুষ। পুরুষের বিকাশ যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন নারীরও বিকাশ। তিনি এ সত্য অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই সমাজের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে শিক্ষা প্রচারের মাধ্যমে নারীসমাজের উন্নতি সাধনের জন্য স্বীয় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। শিক্ষার মাধ্যমেই জাতীয় জাগরণ সম্ভব এ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি শিক্ষাপ্রচার আন্দোলনে ব্রতী হয়েছিলেন। এ আদর্শকে মুসলিম সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে এটাই ছিল বেগম রোকেয়ার মনের দৃঢ় প্রত্যয়। নারী সম্প্রদায়ের অধঃপতিত অবস্থা দেখে অত্যন্ত মর্মাহত ও ব্যথিত হয়েছিলেন। দেশ ও জাতির স্বার্থে মুসলমান নারীসমাজের জাগরণের জন্য তিনি শিক্ষা প্রচার আন্দোলনে ব্রতী হয়েছিলেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, তৎকালীন মুসলমান সমাজে নারী শোচনীয়, করুণ অবস্থা, নারীসমাজের এ পশ্চাৎপদতা, কূপমণ্ডূকতা ও অধঃপতিত অবস্থা থেকে নারীমুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া নারীমুক্তির কোন আশা নাই। কিন্তু এ শিক্ষার পথেও ছিল চরম বাধাবিপত্তি। নারী শিক্ষা অর্জনের পথ রুদ্ধ করেছিল তৎকালীন কঠোর পর্দা প্রথা। সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক কুপ্রথার প্রভাবে নারীরা ছিল গৃহবন্দি। এ শোচনীয় তারা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, মানুষ হিসেবে তার কর্তব্য, দায়িত্ব, সমাজের জন্য তথা দেশের জন্য কিছু করা, আত্মনির্ভরশীলতা প্রভৃতি চিন্তাও তাদের আসত না। তারা ছিল এককথায় মানসিকভাবে পঙ্গু। এ অবহেলিত, অধঃপতিত, মুসলমান নারীদের অবস্থা দেখে যে মহিয়সী নারী সর্বপ্রথম এগিয়ে এসেছিলেন তাদের কল্যাণে, তিনি হলেন বেগম রোকেয়া। যার সারাজীবনের একমাত্র স্বপ্ন ছিল নারীকল্যাণ ও নারীমুক্তি। এ লক্ষ্যে তিনি শিক্ষাবিস্তারের মত মহান কার্যক্রমে ব্রতী হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বেগম রোকেয়া শিক্ষাবিস্তার সম্পর্কিত কার্যক্রমের আদর্শ থেকে তিলমাত্র বিচ্যুত হন নি।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%b6-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%97%e0%a6%ae-%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%95%e0%a7%87/