অথবা, বেগম রোকেয়ার জন্ম কোন ধরনের পরিবেশে?
অথবা, বেগম রোকেয়ার তৎকালীন সামাজিক পরিবেশ কিরূপ ছিল?
অথবা, “বেগম রোকেয়া এক প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেন” ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলার নারী জাগরণে তাঁর অসামান্য অবদান তাঁকে ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়। দর্শন, সমাজবিজ্ঞান সাহিত্যে তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি পুরুষের পাশাপাশি নারীরও সার্বিক বিকাশের কথা বলেন। সমাজের সার্বিক কল্যাণ অর্জনের জন্য শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে নারী সমাজের উন্নতি সাধনের মহান ব্রতে তিনি নিজে জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ মহান বিদুষী নারী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
বেগম রোকেয়ার সময়ের সামাজিক অবস্থা : বেগম রোকেয়ার আবির্ভাবের প্রাক্কালে তৎকালীন সামাজিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। বিশেষ করে নারী সমাজে অবস্থা ছিল সর্বাধিক করুণ। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে ভাগ্য বিপর্যয়ে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। ইংরেজ অধিকারের পর থেকে অবিভক্ত ভারত তথা বাংলাদেশের মুসলমানদের দুর্ভাগ্যের সূচনা। মুসলমানদের অর্থনৈতিক অধঃপতন সমাজকাঠামোকে অত্যন্ত দুর্বল করে ফেলে। ফলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুসলমানগণ পরাজিত হতে থাকে। বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলমান সম্প্রদায় অত্যন্ত পশ্চাৎপদ ছিল। এদেশে ইংরেজ সরকার কর্তৃক শিক্ষাবিস্তার কার্যক্রমের ধারা অনুসরণ করলে দেখা যায়, মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে ১৭৮০ সালে কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮০০ সালে ইংরেজ সিভিলিয়ান কর্মচারীদের বাংলা ভাষা শেখানোর উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। ১৮২৯ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় ইংরেজি ক্লাস খোলা হয় এবং ১৮৩৩ সালে এ প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি অবশ্য পাঠ্য করা হয়। ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে আইনগত কোন বাধা না থাকলেও মূলত আর্থিক সংগতির অভাবেই মুসলমান ছাত্ররা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিল।
২. বাংলাদেশের হিন্দু সমাজ ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে মোটেও পিছিয়ে ছিল না। রামমোহন রায়, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, ডেভিড হেয়ার, স্যার হাইড ইস্টের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৮১৬ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলার উদীয়মান হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা। রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত যুগ পুরুষের আবির্ভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষাবিস্তার ত্বরান্বিত হয়েছিল, সে যুগে শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজ অনেক পিছিয়েছিল। বাংলার মুসলমান সমাজে তখনও পর্যন্ত রাজা রামমোহন রায় কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ন্যায় যুগ পুরুষের আবির্ভাব ঘটে নি। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানদের পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে উঠার জন্য উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সম্মিলিত প্রচেষ্টার অভিব্যক্তি হিসেবে কোন সংঘ বা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায় না। অথচ ধীরগতিতে হলেও উনিশ শতকের প্রথম থেকেই বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের মধ্যে জাগরণের সাড়া সৃষ্টি হয়। ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে তারা ক্ষেত্রে একচ্ছত্র সুবিধা ভোগ করতে থাকে। রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত আত্মীয় সভা (১৮১৫), মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী সভা (১৮৩৯), ডক্টর মুয়াটের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিদ্বোৎসাহিনী সভা (১৮৫৩), কিশোরী চাঁদ মিত্রের
উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সুহৃদ সমিতি (১৮৫৪) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষেত্র হিন্দুসমাজের মধ্যেই ছিল স
ীমাবদ্ধ। সভাসমিতি ও পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানগুলো স্ব-স্ব সমাজের উন্নতি সাধনে ছিল তৎপর। ইংরেজ শাসকবর্গের সাথে আপস আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে হিন্দু সমাজের উন্নতি সাধনে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানসমূহ কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ফলে বাংলার হিন্দু সমাজ স্বল্প সময়ের মধ্যে জ্ঞানে, কর্মে, শিক্ষা, স্বাস্থ্যে প্রভূত উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয়।
৩. উনিশ শতকের শেষার্ধে ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে নওয়াব আবদুল লতিফ এবং সৈয়দ আমীর আলী প্রমুখ মনীষীদের সহযোগিতায় কলকাতায় ‘মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড এলগিনের উৎসাহ ও সহযোগিতায় নবাব আব্দুল লতিফ উক্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার মুসলমানদের কৃষ্টি সচেতন করে তোলার জন্য এটা হলো প্রথম প্রচেষ্টা। ইংরেজ শাসকের সঙ্গে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের সহৃদয় সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা ঘটানোই ছিল মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটির অন্যতম উদ্দেশ্য।
৪. ইংরেজ শাসকবর্গের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আদর্শের সাথে যে ব্রিটিশ ভারত তথা বাংলাদেশের মুসলমানদের সহযোগিতার প্রয়োজন আছে, সে সম্পর্কে নওয়াব আব্দুল লতিফ বিশেষভাবে তাগিদ দিয়েছিলেন। নওয়াব আব্দুল লতিফের অনুসৃত পন্থা সে যুগের অনেক মুসলমান মনীষীর পছন্দনীয় হয় নি। পৃথক সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা তাই অনুভূত হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে ১৮৭৭ সালে স্থাপিত হয় ‘ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন’ । পরে প্রতিষ্ঠানটি ‘সেন্ট্রাল মোহামেডান এসোসিয়েশন’ নামে পরিচিত হয়। এ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন বিচারপতি সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯০৫)। উনিশ শতকের বাঙালি শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বিচার বিভাগে কর্মনিযুক্ত থেকে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতির আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন।একজন চিন্তাশীল লেখক ও ঐতিহাসিক গবেষক হিসেবেও তাঁর কৃতিত্ব অতুলনীয়। মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটির ন্যায় সেন্ট্রাল মোহামেডান এসোসিয়েশন ইংরেজি শিক্ষার আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। তবে ইংরেজ শাসকের প্রতি প্রতিষ্ঠানটির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুসলমানদের প্রতি ইংরেজ শাসকবর্গের মনোভাব এবং মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে ইংরেজ সরকারের সকল কার্যক্রমে সৈয়দ আমীর আলী সমর্থন জানাতে পারেন নি। মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি’ এর উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসকবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা লাভ। অপরপক্ষে, ধীরে ধীরে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনই ছিল ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশনের প্রধান লক্ষ্য।
৫. ১৯০৬ সালে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ স্থাপিত হয় । ভারতীয় মুসলমানদের রাজনীতি সচেতন করে তোলাই ছিল “অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ এর মুখ্য উদ্দেশ্য। উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মক্ষেত্র বাংলার নবাব নাইটদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাদের ছিল না কোন প্রভাব। ফলে অত্যন্ত ধীরগতিতে আশারাক মুসলমানদের জাগরণ ক্রে হয়। এটিই যখন ছিল সাধারণভাবে বাংলার মুসলিম সমাজের অবস্থা তখন এর সবচেয়ে পশ্চাৎপদ অংশ মুসলিম নারীসমাজের উন্নতির কথা চিন্তা করাও দুষ্কর। আধুনিক শিক্ষার সবকটি দরজা সে যুগে মুসলমান মেয়েদের সামনে ছিল রুদ্ধ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, বেগম রোকেয়ার আবির্ভাবের প্রাক্কালে তৎকালীন সমাজে মুসলমানদের শোচনীয় অবস্থা বিরাজ করছিল। এর মধ্যে নারী সমাজ ছিল সবচেয়ে বেশি করুণ অবস্থায়। হিন্দু সমাজ জ্ঞানবিজ্ঞানে এগিয়ে ছিল। তবে মুসলমান সমাজ তাদের দুরবস্থা থেকে বের হয়ে আসার তাগিদ অনুভব করে এবং বেশ কিছু কর্মকাণ্ডও পরিলক্ষিত হয়।