অথবা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের উদ্যোগে বেইজিং প্লাস ফাইভ এর ভূমিকা বর্ণনা কর।
অথবা, বেইজিং প্লাস ফাইভ এর লক্ষ্য এবং জাতিসংঘের ভূমিকা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ কর।
অথবা, বেইজিং প্লাস ফাইভ এর লক্ষ্য এবং জাতিসংঘের ভূমিকা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বেইজিং সম্মেলনের (১৯৯৫) পাঁচ বছর পর আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে ২০০০ সালের ২ জুন থেকে ১০ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ২০০০ সালে নারী একবিংশ লিঙ্গ সমতা, উন্নয়ন ও শান্তি শীর্ষক বিশেষ সভা সংক্ষেপে বেইজিং প্লাস ফাইভ হিসেবে পরিচিত। মূলত বেইজিং সম্মেলনের পর থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিশ্ব জুড়ে
নারীসমাজের উন্নয়নের জন্য সমাজে কতটুকু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং নানা দেশে নারী উন্নয়নে গৃহীত পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, তার একটি পর্যালোচনা এবং মূল্যায়ন করা হয় এ Beijing Plus Five সম্মেলনে। এ সম্মেলনে BPFA এর অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের বাধাসমূহ দূরীকরণের উপায়সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে।
বেইজিং প্লাস ফাইভ ও জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্র : জাতিসংঘের ৪৩ তম অধিবেশনে বেইজিং প্লাস ফাইভ পর্যালোচনা প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৮৮টি দেশের প্রায় ২০০০ প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যোগ দেয়। ১৯৯৯ সালে BPFA বাস্তবায়নে বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্র বা সরকারসমূহ কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা পেশ করতে বলা হয়। এক্ষেত্রে BPFA বাস্তবায়নের
ইতিবাচক দিক, শিক্ষণীয় দিক, বাধাবিপত্তি ও বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের উপর জোর দেয়া হয়।
লক্ষ্য : বেইজিং এ চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে গৃহীত কর্মসূচি বেইজিং প্লাটফর্ম ফর এ্যাকশনের কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, না হয়নি তার পর্যালোচনা করা এর প্রধান লক্ষ্য। বেইজিং সম্মেলনের পর পাঁচটি বছর অতিবাহিত হয়েছে। বেইজিং ঘোষণাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে তাই এ পর্যালোচনা। বিশেষ করে চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের পর পাঁচ বছরে নারী উন্নয়নে তাদের প্রধান বাধাগুলো অপসারণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কাজ হয়নি, এমন ধারণাও এ সম্মেলন
অনুষ্ঠানের কারণ । এ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের পোশাকি নাম ২০০০ সালের নারী একবিংশ শতাব্দীতে লিঙ্গ সমতা,
উন্নয়ন ও শান্তি । গত পাঁচ বছরের ভালো দৃষ্টান্ত, ইতিবাচক কাজ ও এ সময়ের অভিজ্ঞতাগুলোকে পর্যালোচনা করে কাজে
লাগিয়ে বিশ্বব্যাপী নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের জন্য আগামী দিনের কর্মসূচি ও কৌশল
নির্ধারণও ছিল এ সম্মেলনের লক্ষ্য।
জাতিসংঘের ভূমিকা : জাতিসংঘ বেইজিং প্লাস ফাইভ এর পূর্ণতার জন্য নিম্নের সনদ ও চুক্তিগুলো সম্পাদন করেছে :
১. শিশু অধিকার সনদ,
২. সিডো সনদ এবং
৩. আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক অধিকার সনদ।
এছাড়া এর মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন এবং বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদনে জেন্ডার ইস্যুর উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়।
এডহক কমিটি : বেইজিং প্লাস ফাইভ এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং BPFA বাস্তবায়নের পথে বিদ্যমান বাধাসমূহ দূরীকরণের লক্ষ্যে এডহক কমিটির সভায় নিম্নের বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয় :
১. IMF এর কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস,
২. বালিকা শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং
৩.ভূমির উপর নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, যৌন স্বাস্থ্য ও যৌন অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নির্যাতন ও পাচার থেকে রক্ষার ব্যবস্থা।
পাঁচটি ফোকাস এরিয়া : নারী উন্নয়নে পাঁচটি ফোকাস এরিয়া নিম্নরূপ :
১. BPFA বাস্তবায়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি।
২. নারীর অগ্রগতিকে মূল ধারায় নিয়ে আসা।
- BPFA এর উপর জবাবদিহিতা এবং BPFA বাস্তবায়ন পরিমাপ।
৪.BPFA বাস্তবায়নে সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব।
৫. পশ্চাৎপদ নারী-কিশোরীদের সহযোগিতা প্রদান ।
অন্ধকার দিক : Beijing Plus Five এ বলা হয়, বিশ্বের ১৮৯ টি দেশ নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেও এখনও নিম্নের বিষয়গুলোতে অন্ধকার বিরাজ করছে :
১. নারী উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।
২. প্রযুক্তিগত এবং অর্থনৈতিক যুগেও নারীরা শিক্ষা, অর্থ ও ক্ষমতায়নের দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে।
৩. বিশ্বজুড়ে পারিবারিক নির্যাতন মহামারি আকারে ছড়িয়ে রয়েছে।
৪. পারিবারিক সহিংসতা প্রকট রয়েছে।
৫. বিশ্বব্যাপী মজুরি বৈষম্য বিদ্যমান
ysodnes রয়েছে এবং ৭০% নারী মজুরিহীন গৃহশ্রমে নিয়োজিত ।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত কিছু পদক্ষেপ ও সফলতা নিম্নে তুলে ধরা হলো :বাংলাদেশ সরকারের WID Capability সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক রিভিউ ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মধ্যবর্তী সময়ে নয়টি গবেষণার মাধ্যমে পর্যালোচনা সম্পন্ন হয়।
২. ১৯৯৭ সালের ৮ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নারী উন্নয়নে সরকারি নীতি ঘোষণা।
৩. নারী উন্নয়নে জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ।
৪. পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নারী ও শিশু কল্যাণে বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ৪৫ থেকে ৩৩৬ কোটিতে উন্নীত
Beijing Plus এর গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ : জাতিসংঘের ২৩ তম অধিবেশনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইন, জীবনাচরণ এবং মতামতের ভিন্নতা থাকলেও মূল ঘোষণার অধিকাংশ বিষয়ই সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। যেমন—
১. নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ।
২.সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা।
৩.নারী শিক্ষার প্রসার।
৪.মেয়ে শিশুর প্রতি বৈষম্যের অবসান।
৫. নারীর প্রতি সহিংসতা দূরীকরণের জন্য আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ
৬. নারীর প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা প্রদান।
৭.কাজে সমান সুযোগ সুবিধা ও মজুরি প্রদান।
৮. নারী ও শিশু পাচার বন্ধ।
৯. নারীর দারিদ্র্য দূরীকরণসহ সামাজিক নিরাপত্তা বিধান ।
তবে বিশ্বের মৌলবাদী শক্তি পাঁচটি বিষয়ের প্রতি বিরোধিতা করলে বিষয়গুলো সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হতে পারে
নি। যেমন-
ক. · সন্তান ধারণ ও জন্মদানের ক্ষেত্রে অধিকার,
খ. যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অধিকার,
গ. যৌন বিষয়ে শিক্ষা লাভের অধিকার,
ঘ. গর্ভপাতের অধিকারসমূহ এবং
ঙ. সম্পত্তিতে সমানাধিকার।
মৌলবাদীদের এ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বলতে চাই যে, নারীর অধিকার আদায়ের পথে যেসব বাধা রয়েছে তার মধ্যে মৌলবাদীদের বাধা অন্যতম। তাই মৌলবাদী ধারণাকে একটি বাধা মনে করে সমস্যার পথ বের করতে হবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বালিকা এবং নারীর জীবনের অগ্রাধিকারের বিষয়টি
এর নিজস্ব প্রয়োজনেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সকল শিশুর অভাব পূরণের চাবিকাঠি হচ্ছে এ নারীসমাজ। যতদিন পর্যন্ত নারীরা তাদের নিজেদেরকে, তাদের সমাজকে, তাদের পরিবারকে এবং সর্বোপরি এ বিশ্বকে সাহায্য করার জন্য পুরোপুরি ক্ষমতায়িত না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত আমরা সেসব সমস্যার সমাধান করতে পারব না, যেসব সমস্যা আমাদের মানবজাতির ভবিষ্যৎস্বরূপ শিশুদের ভবিষ্যৎকে হুমকির সম্মুখীন করেছে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার যদি রাজনৈতিকভাবে সদিচ্ছা প্রদর্শন করে এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য প্রদানে প্রস্তুত থাকে, তাহলে ২১ শতকের প্রথম দিকের নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নও সুনিশ্চিত করা যাবে। জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান বলেছেন, “পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে নারীর উপর।”