বুদ্ধদেবের নৈতিক উপদেশাবলির অন্তর্নিহিত দার্শনিক তত্ত্বগুলো সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা, গৌতম বুদ্ধের দার্শনিক তত্ত্বাবলি কী কী?
অথবা, বুদ্ধ নৈতিক ধারণার অন্তরালে কী কী দার্শনিক তত্ত্ব প্রদান করেন?
উত্তর৷ ভূমিকা :
বুদ্ধদেব (খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দ) দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনায় তেমন বেশি আগ্রহী ছিলেন না। নৈতিক উপদেশই ছিল তাঁর শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। তবু তাঁর নৈতিক শিক্ষার মূলে কতকগুলো দার্শনিক তত্ত্ব সম্বন্ধে অভিমত পাওয়া যায়। এ মতবাদ প্রধানতঃ চারটি। যথা :
১. প্রতীত্যসমুৎপাদ বা শর্তাধীন সৃষ্টিবাদ; ২. কর্মবাদ; ৩. সর্বব্যাপক পরিবর্তনবাদ বা অনিত্যবাদ বা ক্ষণিকত্ববাদ এবং ৪. অনাত্মবাদ।
১. প্রতীত্যসমুৎপাদ বা শর্তাধীন সৃষ্টিবাদ : বুদ্ধদেবের মতে, এ জগতে কোন বস্তু বা ঘটনা আত্মনির্ভর নয় এবং বিনা কারণে কিছুই ঘটেনি। জাগতিক সকল বস্তুই এক সর্ব ব্যাপক ও অবশ্য স্বীকার্য ‘কার্যকারণ’ নিয়মের অধীন। বৌদ্ধ মতে, এ কার্যকারণ নিয়ম জগতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে চলছে। ঈশ্বর বা অতীন্দ্রিয় চেতনা সত্তার দ্বারা এ নিয়ম পরিচালিত হয় না। এ কার্যকারণ নিয়মকে বৌদ্ধ দর্শনে প্রতীত্যসমুৎপাদ বলা হয়, যার সহজ অর্থ হলো যে কোন বস্তু বা ঘটনা পূর্ববর্তী বস্তু বা ঘটনা হতে সমুৎপন্ন।
২. কর্মবাদ : কর্মবাদ প্রতীত্যসমুৎপাদ বা শর্তাধীন সৃষ্টিবাদের একটি বিশেষ প্রকাশ মাত্র। কর্মবাদ অনুসারে মানুষকে তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করতেই হবে। কর্মবাদ অনুযায়ী মানুষের বর্তমান অবস্থা তার প্রাক্তন কর্মেরই পরিণতি এবং বর্তমান কর্মের পরিণতি হবে ভবিষ্যতের অবস্থা।
৩. সর্বব্যাপক পরিবর্তনবাদ বা অনিত্যবাদ বা ক্ষণিকত্ববাদ : সর্বব্যাপক পরিবর্তনবাদ বা অনিত্যতাবাদ প্রতীত্যসমুৎপাদ হতেই উদ্ভুত হয়েছে। প্রতীত্যসমুৎপাদ অনুযায়ী সকল বস্তু বা ঘটনার কারণ আছে। সুতরাং কারণটির পরিবর্তন হলে কার্যের আবির্ভাব হয় এবং কারণটি ধ্বংস হলে কার্যটিরও ধ্বংস হয়। বুদ্ধদেব বার বার বলেছেন, সব কিছুই
পরিবর্তনশীল, সব কিছুই ধ্বংসশীল এবং সবকিছুই অনিত্য। যার আদি আছে, তার অন্তও আছে, যার জন্ম আছে তার মৃত্যুও আছে। আপাতদৃষ্টিতে কোন বস্তুকে চিরস্থায়ী মনে হলেও আসলে তা চিরস্থায়ী নয়। এ অনিত্যতাবাদকে বুঝানোর জন্য বুদ্ধদেব দুটি উপমার ব্যবহার করেছেন। একটি অগ্নিশিখা এবং অপরটি নদী জলধারা। জগতের সকল কিছুই অগ্নিশিখার মতো চঞ্চল এবং নদীজল ধারার মত পরিবর্তনশীল।
৪. অনাত্মবাদ : বুদ্ধদেব মানুষের মধ্যে শাশ্বত বা চিরন্তন আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাঁর মতে, জগতের সবকিছুই যখন অনিত্য তখন চিরন্তন আত্মার অস্তিত্ব থাকাও সম্ভব নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের বিশ্বাস মানুষের আত্মা নিত্য ও চিরন্তন। দেহের বিনাশ আছে কিন্তু আত্মার বিনাশ নেই, কিন্তু বুদ্ধ আত্মার নিত্যতাকে অস্বীকার করেন।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি, নৈতিক শিক্ষায় বুদ্ধদেবের দার্শনিক তত্ত্বসমূহের লোচনা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। গৌতম বুদ্ধ যে পরিবর্তনশীল দর্শনের পক্ষে মতামত দিয়েছেন তারই প্রতিধ্বনি গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাসের দর্শনে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। আবার আত্মা সম্পর্কীয় গৌতম বুদ্ধের মত পাশ্চাত্য দার্শনিক হিউমের অনুরূপ।