অথবা, বিশ্ব নারী সম্মেলন (১৯৭৫-২০০০) এর রূপরেখা বর্ণনা কর।
অথবা, বিশ্ব নারী সম্মেলন (১৯৭৫-২০০০) সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
অথবা, বিশ্ব নারী সম্মেলন (১৯৭৫-২০০০) এর রূপরেখা আলোচনা কর।
অথবা, বিশ্ব নারী সম্মেলনসমূহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : জাতিসংঘ ১৯৪৫ সালে নারী-পুরুষের মাঝে সমতার লক্ষ্যে জাতিসংঘ সনদ গ্রহণ করা থেকে। শুরু করে অদ্যাবধি নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। নারীর অগ্রগতি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালকে ‘বিশ্ব নারী বর্ষ’ এবং ১৯৭৬-৮৫ সালকে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব নারী দশক’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি বৈষম্যের কারণ নির্ণয় ও উত্তরণের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে এ পর্যন্ত পাঁচটি বিশ্ব নারী সম্মেলনের আয়োজন করা বিশ্ব নারী অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। তবে জাতিসংঘ গৃহীত ১৯৭৯ সালের CEDAW সনদকে নারী বর্ষ ও নারী দশকের অসামান্য বিজয় হিসেবে লাভ করতে সমর্থ হয়েছে বিশ্বের নারীসমাজ।
বিশ্ব নারী সম্মেলন : এ পর্যন্ত জাতিসংঘ পাঁচটি বিশ্ব নারী সম্মেলনের আয়োজন করেছে, যা নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি ও তা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সম্মেলনগুলো এ কারণে বিশ্ব নারী অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। সম্মেলনগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. মেক্সিকো > সিটি প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলন-১৯৭৫ : মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটিতে প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এ সম্মেলনে পরবর্তী পাঁচ বছরের লক্ষ্য অর্জনে কিছু বিশ্ব কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এগুলো নিম্নরূপ :
ক. নারীদের সাক্ষরতা ও শিক্ষা বৃদ্ধির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ ।
খ. সুযোগের সমপ্রবেশকাম্যতা।
গ.চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি ।
ঘ. বৈষম্যের বিলোপ ।
ঙ.নীতিনির্ধারণী অবস্থানে বেশিসংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ উৎসাহিত ও নিশ্চিত করা।
চ. নারীর জন্য জনকল্যাণমূলক নীতির উপর বেশি গুরুত্ব দান।
ছ. নাগরিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অধিকারের সমতা নিশ্চিত করা।
জ. নারী শ্রমমূল্যের অর্থনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া।
ঝ. নারী সংগঠনকে উৎসাহিত এবং নিশ্চিত করা।
ঞ. গ্রামীণ প্রযুক্তি ও সেবামূলক কার্যাবলির উন্নয়ন।
২. কোপেন হেগেন > দ্বিতীয় বিশ্ব নারী সম্মেলন- ১৯৮০: ১৯৮০ সালের ১৪ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ডেনমার্কের রাজধানী কোপেন হেগেনে দ্বিতীয় বিশ্ব নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে নারীর অধিকার রক্ষা ও উন্নয়নে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়নের আবেদন জানায়। পরিকল্পনাগুলো নিম্নরূপ :
ক. নারী দশকের দ্বিতীয় অর্ধ সময়ের জন্য গুণগত এবং সংখ্যাগত লক্ষ্য নির্ধারণ ।
খ. নারী সংগঠনসমূহের কার্যকর সংযোগ সাধনে প্রশাসনিক কাঠামো প্রবর্তন।
গ. রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে সম অধিকার নিশ্চিত করে আইন প্রণয়ন।
ঘ. এমন উপায় বের করা যেন গণমাধ্যমে নারী বিষয়টি প্রতিফলিত হয়। সাথে সাথে সংশোধনমূলক পদক্ষেপের বাস্তবায়ন করা
৩. নাইরোবী > তৃতীয় বিশ্ব নারী সম্মেলন- ১৯৮৫ : ১৯৮৫ সালের ১৫ জুলাই থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত আফ্রিকা মহাদেশের কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবীতে তৃতীয় বিশ্ব নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলন নারী দশকের সমাপ্তি পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নারী দশকের অগ্রগতি নিয়ে এ সম্মেলনে পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। ১২৪টি দেশের প্রাপ্ত রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, নারী দশকের উদ্দেশ্য আংশিক অর্জিত হয়েছে এবং অনেক রাষ্ট্রে নারীর সমতার অনুপস্থিতি একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ সম্মেলনেও কিছু কর্মকৌশল ঘোষিত হয় । যথা :
ক. রাজনৈতিক সদিচ্ছার ভিত্তিতে একটি আইন কাঠামো নিশ্চিত কর
ে রাষ্ট্র নারী-পুরুষের সাম্য নিশ্চিত করবে।
খ. সরকার আইনের চোখে নারী-পুরুষের সাম্য নিশ্চিত করবে।
গ. সনাতনী ভাবাদর্শে নারীর অগ্রগতি ও উন্নয়নে যে বাধা তৈরি হয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে দূর করা হবে।
ঘ, সমাজে নারীর অনানুষ্ঠানিক এবং অদৃশ্য অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মের স্বীকৃতি নিশ্চিত করা।
ঙ.নারীর বুদ্ধিভিত্তিক উন্নয়ন, নীতিনির্ধারক এবং পরিকল্পনা প্রণয়নকারী হিসেবে উন্নত হতে সকল নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
চ.ফৌজদারি আদালত ব্যবস্থায় নারীর প্রতি ন্যায্য এবং সম আচরণ নিশ্চিত করা।
ছ, নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা দমনে সরকার অবশ্যই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৪. বেইজিং > চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন ১৯৯৫ : ১৯৯৫ সালের ৪ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীনের রাজধানী বেইজিং এ চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আগত প্রতিনিধিরা নাইরোবী সম্মেলনে গৃহীত “Forward looking strategy for the advancement of women” পর্যালোচনা ও পুনর্মূল্যায়ন করেন। এ সম্মেলনে সে আলোকে একবিংশ
শতাব্দীর বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দাবি মিটাতে নারীকে যোগ্য করে গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এ সম্মেলনে সমাজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নারীর ক্ষমতায়নকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করে। জেন্ডার সাম্য, উন্নয়ন ও শান্তির জন্য একটি বৈশ্বিক নীতিমালা প্রণয়নে এ সম্মেলন আহ্বান জানায়। এ সম্মেলন কর্মসূচি বাস্তবায়নে একটি প্লাটফরম নিশ্চিত করে।
৫. নিউইয়র্ক > বেইজিং গ্লাস ফাইভ সম্মেলন- ২০০০ : আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে ২০০০ সালের ২ থেকে ১০ জুন তারিখে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ২০০০ সালে নারী এক শতকে লিঙ্গ, সমতা, উন্নয়ন ও শান্তি শীর্ষক বিশেষ সভা সংক্ষেপে বেইজিং প্লাস ফাইভ হিসেবে পরিচিত। এ সম্মেলনে গত পঁচিশ বছরে বিশ্বের নানা দেশের নারী-পুরুষের
মধ্যকার অবস্থান ও মর্যাদাগত বৈষম্যের কারণে নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণপূর্বক নারীর অগ্রগতি, উন্নয়ন, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নির্যাতনের মূলোৎপাটনে অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়। সম্মেলনে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু গৃহীত হয়। এগুলো হলো :
ক. নারীনির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ।
গ. নারীর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ।
ঙ. নারী ও সশস্ত্র সংঘাত।
ছ. নারীর ক্ষমতায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী।
খ. নারী ও দারিদ্র্য।
ঘ. নারী ও স্বাস্থ্য।
চ. নারী ও অর্থনীতি।
জ. নারী উন্নয়নের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাসমূহ ।
ঝ. নারীর মানবাধিকার ।
ঞ. প্রচার মাধ্যমে নারী |
ট. পরিবেশ রক্ষায় নারী।
ঠ. মেয়ে শিশু।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, মূলত সারা বিশ্বে নারীর অধিকার ও তাদের মানবিক মর্যাদা রক্ষা করার জন্য সর্বক্ষেত্রে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ করার লক্ষ্যে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। আর এ প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হয় ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম বিশ্ব নারী সম্মেলন। এ সম্মেলন আয়োজন করার মূল কারণ নারী বিশ্ব নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি। বৈষম্যের কারণ নির্ণয় ও উত্তরণের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করা। তাই বলা হয়,সম্মেলনসমূহ বিশ্ব নারী অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত।