হ্যাঁ, উক্তিটির (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পুঁইমাচা’ সন্তান বাৎসল্যের একখানা প্রামাণ্য দলিল) আলোকে অন্নপূর্ণার চরিত্র বিশ্লেষণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ‘পুঁইমাচা’ গল্পে অন্নপূর্ণা হলেন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের গৃহকর্ত্রী এবং তিন কন্যার জননী। আপাতদৃষ্টিতে তাকে কঠোর ও বাস্তববাদী মনে হলেও, তার চরিত্রের অন্তরালে লুকিয়ে আছে গভীর স্নেহবাৎসল্য যা উক্তিটিকে সার্থক করে তোলে।
অন্নপূর্ণার চরিত্রের প্রধান দিকগুলি এবং সন্তানবাৎসল্যের প্রকাশ
অন্নপূর্ণার চরিত্রের মধ্যে যে দিকগুলি তার সন্তানবাৎসল্যকে প্রমাণ করে, সেগুলি নিম্নরূপ:
- বাস্তবজ্ঞান ও কর্তব্যবোধ:
- অন্নপূর্ণা অত্যন্ত বাস্তববাদী এবং কর্তব্যপরায়ণ নারী। দরিদ্র সংসারে তিনি কঠোর হাতে হাল ধরেন।
- তাঁর স্বামী সহায়হরি চাটুয্যের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং উদাসীনতার জন্য তিনি প্রায়শই বিরক্তি প্রকাশ করেন। এটি কেবল স্বামীর প্রতি রাগ নয়, বরং তিন মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রতি গভীর দুশ্চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
- বিশেষত, বড় মেয়ে ক্ষেন্তির বয়স হয়ে যাওয়ায় তার বিয়ে নিয়ে তিনি সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকেন। সমাজে একঘরে হওয়ার ভয় এবং মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে তার চিন্তা থেকেই তাঁর মাতৃ-হৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যায়।
- কঠোরতার অন্তরালে স্নেহ:
- ক্ষেন্তি যখন পুঁইশাক ও কুচো চিংড়ি চেয়ে এনেছিল, তখন অন্নপূর্ণা দরিদ্রতার কারণে এবং সমাজের চোখে একঘরে হওয়ার আশঙ্কায় প্রথমে ক্রোধের বশে তাকে তা ফেলে দিতে বাধ্য করেন।
- কিন্তু এটাই অন্নপূর্ণার বাৎসল্যের চরম প্রমাণ। তাঁর এই কঠোরতা নিরুপায়তা থেকে আসে, কারণ তিনি চান না যে তাঁর মেয়ে সমাজের চোখে ‘উচ্ছিষ্ট-ভোগী’ বা তার বাবার অকর্মণ্যতার জন্য অপদস্থ হোক।
- পরে, যখন বাড়িতে কেউ থাকে না, তখন তিনি গোপনে ফেলে দেওয়া পুঁইশাক কুড়িয়ে এনে রান্না করেন। এই কাজটি তার গোপন বাৎসল্যের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি জানেন যে পুঁইশাক ক্ষেন্তির কত প্রিয়, তাই নিজের রাগকে দমন করে গোপনে মেয়ের পছন্দের খাবার তৈরি করে তাকে তৃপ্তি দিতে চেয়েছেন।
- নিঃশব্দ শোক ও বেদনা:
- ক্ষেন্তির বিয়ের পর তার শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত হওয়া এবং বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুর ঘটনাটি অন্নপূর্ণার জীবনে এক নিদারুণ আঘাত হানে।
- গল্পের শেষে, ক্ষেন্তির হাতে লাগানো পুঁইগাছটি যখন মাচা জুড়ে বেড়ে ওঠে, তখন সেই পুঁইগাছটি অন্নপূর্ণার কাছে তাঁর মৃত মেয়ের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে ওঠে।
- পিঠে তৈরির সময় ছোট মেয়ে পুঁটির কাছ থেকে যখন অন্নপূর্ণা শোনেন, “দিদি বড় ভালোবাসতো!”—তখন অন্নপূর্ণার নিঃশব্দ হাহাকার ও বাৎসল্যের চরম প্রকাশ ঘটে। এই নীরব বেদনা থেকেই বোঝা যায়, ক্ষেন্তির প্রতি তাঁর ভালোবাসা কতটা গভীর ছিল।
উপসংহার
অন্নপূর্ণা কেবল একজন নারী নন, তিনি তৎকালীন দরিদ্র গ্রাম-বাংলার এক আদর্শ মা। অভাব, সামাজিক চাপ এবং স্বামীর দায়িত্বহীনতা—এই সবকিছুর সঙ্গে সংগ্রাম করেও তিনি তাঁর মাতৃত্বের ধর্ম পালন করে গেছেন। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ, তা আপাতদৃষ্টিতে কঠোর হোক বা গোপনে বাৎসল্যের প্রকাশ, সবই ছিল তাঁর সন্তানদের মঙ্গলকামনা থেকে উৎসারিত। ক্ষেন্তির প্রতি তাঁর গভীর, অব্যক্ত স্নেহবাৎসল্য গল্পটিকে এক প্রামাণ্য দলিলের মর্যাদা দিয়েছে।


