অথবা, “শামসুর রাহমানের ‘বারবার ফিরে আসে’ বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও গণ-আন্দোলনের প্রেরণাদীপ্ত কবিতা”- এ উক্তির আলোকে কবিতাটি বিশ্লেষণ কর।
অথবা, ‘বার বার ফিরে আসে’ কবিতায় কবি সংগ্রামী জনতার যে আত্মত্যাগের কথা প্রকাশ করেছেন তার স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা : বাংলাদেশের এক অগ্নিঝরা অস্থির সময়ের পটভূমিকায় নির্মিত হয়েছে কবি শামসুর রাহমানের (১৯২৯- ২০০৬) ‘বার বার ফিরে আসে’ কবিতাটি। কবির ‘দুঃসময়ের মুখোমুখি’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত বার বার ফিরে আসে’ কবিতাটিতে উনিশ শ’ বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে উনিশ শ’ একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত রক্তঝরা সংগ্রামের কাব্যিক ব্যঞ্জনা ধারণ করা হয়েছে। এর ভিতর দিয়ে কবির দেশাত্মবোধের পরিচয়টি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশ নামের আমাদের এ প্রিয় দেশটি প্রাচীনকাল থেকে বিদেশি শাসককর্তৃক শাসিত ও শোষিত হয়ে আসছে। এদেশের মানুষ যখনই রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছে তখনই শাসকগোষ্ঠী চালিয়েছে নির্যাতনের স্টীম রোলার। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের মধ্য দিয়ে এ ভূখণ্ডটি পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের প্রদেশে পরিণত হয়। ব্রিটিশের বদলে পাঞ্জাবিরা আমাদের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা সেজে বসে। তারা প্রথমেই আমাদের মাতৃভাষা বাংলার উপর আঘাত হানে। মার খাওয়া বাঙালিরা গর্জে উঠে। উনিশ শ’ বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এদেশের দামাল ছেলেরা রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করে। এখান থেকেই শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে রক্ত ঝরার ইতিহাস। কবি শামসুর রাহমান এ রক্তে রাঙানো ঘটনাবলি স্মরণ করে এ কবিতায় তাঁর দেশাত্মবোধকে কাব্যিক সুষমায় রঞ্জিত করে ব্যক্ত করেছেন।
গণজাগরণ : কোন জাতি যখন তার স্বাধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তখন সে তা ফিরে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও হয়েছিল তাই। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন শোষণে অতিষ্ঠ বাঙালি তার স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ঊনসত্তরে রাস্তায় নেমেছিল মরণ খেলায়। আবাল বৃদ্ধ বণিতা কেউ ঘরে বসেছিল না। সেই গণজাগরণ সম্পর্কে কবির লেখনী লিখেছে-
“উনিশ শো ঊনসত্তরের
তরুণ চীৎকৃত রৌদ্রে যে ছেলেটা খেলতো রাস্তায়,
বানাতো ধুলোর দুর্গ, খেতো লুটোপুটি নর্দমার ধারে
বিস্ময়ে দেখতো চেয়ে ট্রাক, জীপ
রাইফেল, টিউনিক, বেয়োনেট, বুট, হেলমেট
এখন সে টলমল পদভরে শরীক মিছিলে।
লাজনম্র যে মেয়েটি থাকতো আড়ালে সর্বক্ষণ,
যে ছিল অসূর্যম্পশ্যা, এখন ঝলসায় মিছিলে মিছিলে।”
দেশাত্মবোধ কী : নিজের দেশকে ভালোবাসার প্রেরণার নামই দেশাত্মবোধ। প্রত্যেকটি মানুষ তার নিজের দেশ অর্থাৎ জন্মভূমিকে ভালোবাসে। দেশাত্মবোধের তাড়না থেকেই মানুষের মধ্যে দেশসেবা ও দেশপ্রেমের জন্ম হয়। যে মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম নেই তার মতো হতভাগ্য আর খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশপ্রেমহীন মানুষদের জন্যই দেশের ভাগ্যে দুর্যোগ নেমে আসে। যে দেশের মানুষ যত দেশপ্রেমিক সে দেশ তত উন্নত ও সমৃদ্ধ। কবির ভাষায়-
“স্বদেশের উপকারে নাই যার মন
কে বলে মানুষ তারে পশু সেই জন।”
কবির দেশাত্মবোধ : কবি শামসুর রাহমান বাংলাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। এ দেশের প্রত্যেকটি স্বার আন্দোলনে তিনি পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর লেখনী সর্বদা দেশ ও জাতির সেবায় সক্রিয়। এ দেশটাকে কৰি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসেন। এদেশের রক্তাক্ত ইতিহাস তাঁর স্মৃতিতে সব সময় জাজ্বল্যমান। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশটির স্বাধীনতাকে আমাদের কিনতে হয়েছে। এ স্বাধীনতা যুদ্ধে কবি ছিলেন এক সক্রিয় সৈনিক। ঊনসত্তরের শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট সেদিন মিছিলের পতাকা হয়ে যে আগুন ছড়িয়েছিল এ দেশের কোটি কোটি দেশপ্রেমিক মানুষের সাথে কবিও সে আগুনে নিজেকে উত্তপ্ত করে রাস্তায় নেমেছিলেন। বার বার ফিরে আসে’ কবিতায় সেসব আগুন ঝরা দিনগুলোর কথা বর্ণনা করতে গিয়ে কবি নিজের দেশাত্মবোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
কবির জিজ্ঞাসা : ঊনসত্তরের শহীদ আসাদের রক্তরঞ্জিত শার্ট ছিল আন্দোলনের জ্বলন্ত প্রতীক। কবির স্মৃতিতে এ শার্ট আজও জাজ্বল্যমান। বার বার এ শার্ট এ দেশের শহরে ও গ্রামে ফিরে ফিরে আসে। বার বার তা মানুষকে স্বদেশের প্রতি সজাগ করে তোলে। কবি এর কাছে থেকে প্রেরণা পান। এ শার্ট তাকে দেশ ও জাতির সম্পর্কে সচেতন করে। কবি সাবধান হন দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। কারণ যারা এ শার্টকে রক্তাক্ত করেছিল তারা বার বার এ কাজ করেছে এবং ভবিষ্যতেও করতে চাইবে; কবি লিখেছেন-
“আমাকেই হত্যা করে ওরা, বায়ান্নোর রৌদ্রময় পথে,
আমাকেই হত্যা করে ওরা
ঊনসত্তরের বিদ্রোহী প্রহরে,
একাত্তরে পুনরায় হত্যা করে ওরা আমাকেই
আমাকেই হত্যা করে ওরা
৷ পথের কিনারে এভেন্যুর মোড়ে, মিছিলে, সভায়
আমাকেই হত্যা করে ওরা হত্যা করে বার বার তবে কি আমার
বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহীদ মিনার হয়ে যাবে?”)
এ দেশের শত্রুরা বিভিন্ন সময়ে আমাদের হত্যা করেছে। ওরা এখনো সক্রিয়। এভাবে হত্যা করতে করতে, শহীদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে কি গোটা বাংলাদেশটাই এক বিশাল শহীদ মিনারে পরিণত হবে? কবির দেশপ্রেমিক মন এ প্রশ্ন করেছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কবি বাংলাদেশকে গভীরভাবে ভালোবাসেন। এ দেশের রক্তরঞ্জিত ইতিহাসের স্মৃতিচারণ করে কবি তাঁর দেশাত্মবোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। দেশের শত্রুদের সম্পর্কে সজাগ থাকার জন্যও তিনি সকলকে সতর্ক করে দিয়েছেন। আর কেউ যাতে এদেশবাসীকে ধ্বংস করতে না পারে সেজন্য কবি সচেষ্ট রয়েছেন।