অথবা, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধ অনুসরণে প্রাচীনপস্থিদের যুক্তিগুলো নিজের ভাষায় লিখ।
অথবা, বাঙ্গালা সাহিত্যের ভাষা প্রয়োগ সম্পর্কে পণ্ডিত রামগতি ন্যায়রত্নের মতামত বিশ্লেষণ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : বাংলা সাহিত্যের আধুনিক পর্বের সূচনালগ্নে বাংলা গদ্যকে যিনি প্রাণস্পর্শী, জনপ্রিয় এবং সুষমামণ্ডিত করে তোলেন তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বাঙ্গালা ভাষা শীর্ষক প্রবন্ধটি বাংলা গদ্যের উন্মেষ পর্বের গতি প্রকৃতির বিদগ্ধ পর্যবেক্ষণ ও ভাষাচিন্তার স্বরূপ বিশ্লেষণে একটি অসাধারণ সৃষ্টি। সমকালে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে প্রাচীনপন্থি এবং নব্যপন্থিদের মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধ ঘনিয়ে উঠে। প্রাচীনপন্থিরা হলেন সংস্কৃতানুসারী, আর নব্যপন্থিরা হলেন সংস্কৃত বিরোধী। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এদের কাউকেই অন্ধভাবে সমর্থন না করে মধ্যমপন্থা বেছে নেন এবং উভয় সম্প্রদায়ের মতামতের ভিত্তিতে বাংলা গদ্যের একটি উৎকৃষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন করেন।
বাংলা গদ্যের রূপবদল : সংস্কৃতসেবী পণ্ডিতবর্গের একঘেঁয়েমির ফলে বাংলা গদ্য অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করে। দুর্বোধ্য সংস্কৃত বাহুল্যের কারণে বাংলা সাহিত্য অতিশয় নীরস, শ্রীহীন, দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সাধারণের সমাদর লাভে তা ব্যর্থ হয়। প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুর বাংলা ভাষার এ দুর্দশা দেখে বাংলা ভাষার আত্মমুক্তিতে যত্নবান হলেন। তিনি সংস্কৃত ভাষার বিষবৃক্ষের মূলে কুঠারাঘাত করলেন। তিনি সকলের সহজবোধ্য কথ্য ভাষায় ‘আলালের ঘরের দুলাল’ রচনা করলেন। এভাবে প্যারীচাঁদ মিত্র কথ্যরীতিতে গ্রন্থ রচনা করে বাংলা গদ্যের রূপবদল ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটালেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, “সেদিন হইতে বাঙ্গালা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি। সেদিন হইতে শুদ্ধ তরুর মূলে জীবনবারি নিষিক্ত হইল।” অতঃপর সাধু এবং কথ্য উভয় ভাষাতেই বাংলা গ্রন্থ প্রণয়ন হতে থাকে।
সংস্কৃতবাদীদের প্রতিক্রিয়া : আলালের ঘরের দুলাল’ প্রকাশিত হওয়ার পর সংস্কৃতসেবী পণ্ডিতবর্গ খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। কারণ কথ্যভাষা তাঁদের কাছে বড়ই ঘৃণ্য। এ ভাষাকে তাঁরা সাহিত্যে ব্যবহারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। লেখকের ভাষায়- “যে গ্রন্থে সংস্কৃতমূলক শব্দ ভিন্ন অন্য শব্দ ব্যবহার হয়, তাহা তাঁহাদের বিবেচনায় ঘৃণার যোগ্য।” মদ্য, মুরগী এবং টেকচাঁদী বাংলা প্রচলিত হয়ে সংস্কৃতসেবী ভট্টাচার্য গোষ্ঠীকে আকুল করে তুলল এবং এ থেকে ভিন্নমতাবলম্বী দুটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হলো।
রামগতি ন্যায়রত্নের যুক্তি : উনিশ শতকের উন্মেষলগ্নে বাংলা গদ্যের বিচলিত পর্বে সংস্কৃতসেবী পণ্ডিতবর্গ কথ্যভাষায় গ্রন্থ প্রণয়নের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এ সংস্কৃতপ্রিয় গোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয়। তিনি সংস্কৃতে সুশিক্ষিত ছিলেন। ইংরেজি জানতেন না, পাশ্চাত্য সাহিত্যে তাঁর কোন দখল ছিল না। “পাশ্চাত্য সাহিতের অনুশীলনে যে সুফল জন্মে, ন্যায়রত্ন মহাশয় তাহাতে বঞ্চিত। সংস্কৃত ভাষায় গ্রন্থ প্রণয়নের পক্ষে তিনি কতিপয় যুক্তি প্রদর্শন করেন। তাঁর যুক্তিগুলো নিম্নরূপ :
১. দুর্বোধ্য সংস্কৃত ভাষা হবে গ্রন্থ প্রণয়নের একমাত্র অবলম্বন, কারণ এ ভাষা পিতা-পুত্রে একত্রে বসে অসঙ্কুচিত চিত্তে পাঠ করা যায়।
২. সংস্কৃত ভাষা গুরুজনের সামনে উচ্চারণ করতে কোন প্রকার সঙ্কোচ হয় না।
৩. সংস্কৃত ভাষায় লিখিত পুস্তক বিদ্যালয়ে পাঠ্য হিসেবে নির্বাচন করতে কোন অসুবিধা নেই।
৪. কথ্য ভাষা শিক্ষাপ্রদ নয়, কারণ তা সবার সামনে পাঠ করতে লজ্জাবোধ হয়।
৫. কথ্য বা আলালী ভাষায় গ্রন্থ রচনা করা উচিত নয়।
রামগতি ন্যায়রত্রের সমালোচনা : রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয় স্বপ্রণীত বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাবে
‘আলালী’ এবং ‘’হুতোমী’ ভাষা সম্পর্কে তীব্র কটাক্ষপূর্ণ সমালোচনা উপস্থাপন করেছেন। তিনি এ ভাষায় অশ্লীলতার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে উল্লেখ করেছেন, “আলালের ঘরের দুলাল বল, হুতোমপেঁচা বল, মৃণালিনী বল- পত্নী বা পাঁচজন বয়স্যের সহিত পাঠ করিয়া আমোদ করিতে পারি কিন্তু পিতা-পুত্রে একত্র বসিয়া অসঙ্কুচিতমুখে কখনই ওসকল পড়িতে পারি না। বর্ণনীয় বিষয়ের লজ্জাজনকতা উহা পড়িতে না পারিবার কারণ নহে, ঐ ভাষারই কেমন একরূপ ভঙ্গী আছে, যাহা গুরুজনসমক্ষে উচ্চারণ করিতে লজ্জাবোধ হয়।” তাই সাহিত্য রচনার আদর্শ হিসেবে এরূপ ভাষা কখনোই গৃহীত হতে পারে না বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের অভিমত : সংস্কৃতবাদী প্রাচীন সম্প্রদায়ের মুখপাত্র রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয়ের মতামতকে বঙ্কিমচন্দ্র সমর্থন করেন নি। তিনি তাঁর নিজস্ব বিচার বিশ্লেষণ ও যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ন্যায়রত্ন মহাশয়ের একঘেয়েমিপূর্ণ মতামতের দুর্বলতা ও অসারতা প্রমাণ করেছেন। ন্যায়রত্ন মহাশয়ের বিবেচনায় পিতা-পুত্রে বড় বড় সংস্কৃত শব্দে কথোপকথন করা কর্তব্য; প্রচলিত ভাষায় কথোপকথন হতে পারে না। বঙ্কিমচন্দ্র মনে করেন যে, এ আইন প্রচলিত হলে সন্তানকে মায়ের কাছে খাবার চাওয়ার সময় বলতে হবে, “হে মাতঃ খাদ্যং দেহি মে’ অথবা পিতার কাছে জুতা চাওয়ার সময় বলতে হবে “ছিন্নেয়ং পাদুকা মদীয়া।” আসলে দীর্ঘ সমাসপরম্পরা বিন্যাসে অধিক বিদ্যার্জন অসম্ভব। কারণ যা বুঝতে পারা না যায় তা থেকে কিছু শিক্ষালাভ হয় না। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, ‘সরল ভাষাই শিক্ষাপ্রদ’। ন্যায়রত্ন মহাশয় নিজে যে ভাষায় ‘বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব, লিখেছেন তাও সরল প্রচলিত ভাষা। কাজেই সরল প্রচলিত ভাষার সমালোচনা করার অধিকার তাঁর নেই। টেকচাঁদী ভাষার প্রভেদ কেবল এ যে, টেকচাদে রঙ্গরস আছে, ন্যায়রত্নে কোন রঙ্গরস নেই। ন্যায়রত্ন মশায় লিখেছেন যে, রঙ্গরসের কারণে পিতা-পুত্রে একসাথে বসে আলালী ভাষার সাথে তাঁর ভাষার রচনা পাঠ করতে লজ্জাবোধ করে। তাই বঙ্কিমচন্দ্রের অভিমত, “ভাষা হইতে রঙ্গরস উঠাইয়া দেওয়া যদি ভট্টাচার্য মহাশয়দিগের মত হয় তবে তাহারা সে বিষয়ে যত্নবান হউন। কিন্তু তাই বলিয়া অপ্রচলিত ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা করিতে চেষ্টা করিবেন না।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পেক্ষিতে বলা যায় যে, দুর্বোধ্য ভাষায় অধিক জ্ঞানার্জন কখনোই সম্ভব নয়। আসলে সরল ভাষাই শিক্ষাপ্রদ। সংস্কৃতবাদী প্রাচীনপন্থিদের প্রতিনিধি ন্যায়রত্ন মহাশয় বাংলা রচনার পক্ষে যেসব যুক্তি আরোপ করেছেন তা মাটেই গ্রহণযোগ্য নয়।