অথবা, ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা চিন্তার যে পরিচয় পাওয়া যায় তা আলোচনা কর।
অথবা, ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাঙ্গালা রচনার উৎকৃষ্ট রীতি সম্পর্কে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা তোমার নিজের ভাষায় লেখ।
অথবা, ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধে বাংলা রচনার ভাষারীতি সম্পর্কে যেসব মতবাদ নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা বর্ণনা কর এবং এ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের মত তুলে ধর।
উত্তর ভূমিকা : উনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালি মননে বঙ্কিমচন্দ্রের যুক্তিবাদী চেতনা এবং শিল্প-সংবেদনার প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। তিনি জাতীয় জীবনের অন্তচেতনাকে যেমন করে আত্মস্থ করেছিলেন তেমনি পাশ্চাত্য সমাজ-সভ্যতা-ইতিহাস- দর্শনেও তাঁর অধিকার ছিল ঈর্ষণীয়। পণ্ডিত ও শিল্পানুরাগী পাঠক প্রত্যেকেই প্রবল আকর্ষণ অনুভব করতেন বঙ্কিমের সৃষ্টিতে। তিনি বাংলা উপন্যাসের সার্থক জনক হিসেবে স্বীকৃত হলেও বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ধারায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলা গদ্যের উৎকর্য সাধনে বিদ্যাসাগরের সংস্কৃতানুসারী ভাষা ও আলালী কথ্য বাকভঙ্গি নতুনভাবে বিন্যস্ত করে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা গদ্যকে প্রাণস্পর্শী ও সুষমামণ্ডিত করে তোলেন। ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধে তিনি প্রাচীনপন্থি ও নব্যপন্থীদের ভাষাচিন্তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করে বাংলা ভাষার উৎকৃষ্ট রচনারীতি সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন।
বাংলা ভাষার রূপ বৈচিত্র্য : পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই লিখিত ভাষা এবং কথিত ভাষার মধ্যে ব্যাপক প্রভেদ রয়েছে। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও অনুরূপ পার্থক্য পরিদৃষ্ট। এর “একটির নাম সাধুভাষা; অপরটির নাম অপর ভাষা। একটি লিখিবার ভাষা, দ্বিতীয়টি কহিবার ।।” বাংলা গদ্যের প্রারম্ভিক পর্বে বই-পুস্তকে সাধু ভাষা ভিন্ন অপর ভাষা অর্থাৎ কথ্যভাষা ব্যবহৃত হতো না। যেসব শব্দ বিশুদ্ধ সংস্কৃত নয়, সাধু ভাষায় সেসব শব্দের প্রবেশাধিকার ছিল না। “লোকে বুঝুক বা না বুঝুক আভাঙ্গা সংস্কৃত চাহি।” কিন্তু অপর ভাষা সেদিকে না গিয়ে যা সবার জন্য সহজবোধ্য তা-ই ব্যবহার করে।
প্রাচীনপস্থিদের ভাষাচিন্তা : বাংলা লেখ্য গদ্যের প্রাথমিক পর্বের সূচনা হয় সংস্কৃত পণ্ডিতদের গদ্যচর্চার মাধ্যমে। চিন্তাচেতনায় এঁরা সবাই ছিলেন প্রাচীনপন্থি। সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ ও শব্দ সম্ভারের আদর্শে এসব লেখক বাংলা গদ্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁরা সংস্কৃতেই নিজেদের গৌরব এবং বাংলা ভাষার গৌরব মনে করতেন। যেমন “গ্রাম্য বাঙ্গালি স্ত্রীলোক মনে করে যে, শোভা বাড়ুক আর না বাড়ুক, ওজনে ভারি সোনা অঙ্গে পরিলেই অলংকার পরার গৌরব হইল।” তাঁদের গদ্যে অপ্রচলিত ও দুর্বোধ্য সংস্কৃত শব্দের আধিক্য ছিল। এ গ্রন্থকর্তারা অধিকন্তু মনে করতেন, “ভাষা সুন্দর হউক বা না হউক, দুর্বোধ্য সংস্কৃতবাহুল্য থাকিলেই রচনার গৌরব হইল।” সংস্কৃতবাহুল্যের কারণে সাধারণ মানুষের কাছে এঁদের ভাষা বোধগম্য ছিল না।
নব্যপন্থিদের ভাষাচিন্তা : ভাষাচিন্তার ক্ষেত্রে নব্যপন্থিরা ছিলেন প্রাচীনপন্থিদের সম্পূর্ণ বিপরীত। সংস্কৃত ভাষার কারাগার থেকে বাংলা ভাষাকে মুক্ত করাই ছিল তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। দুর্বোধ্য সংস্কৃত শব্দ পরিহার করে সরল বাংলা শব্দ ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন নব্যপন্থি লেখকরা। এদের অগ্রদূত প্যারীচাঁদ মিত্র লোকমুখে প্রচলিত কথ্য ভাষা ব্যবহার করে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ রচনা করে দেখালেন যে কথ্য ভাষায়ও সাহিত্য রচনা করা সম্ভব। মূলত “সেই দিন হইতে বাঙ্গালা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি। সেই দিন হইতে শুষ্ক তরুর মূলে জীবনবারি নিষিক্ত হইল।” এরপর থেকে সাধু ভাষা এবং কথ্য ভাষা- উভয় রীতিতেই বাংলাগ্রন্থ প্রকাশিত হতে থাকল। প্রাচীনপন্থিরা এটাকে মেনে নিতে সম্মত হলেন না। তাঁরা ভীষণ ঈর্ষান্বিত হয
়ে উঠলেন। কারণ অপর ভাষা তাঁদের কাছে ছিল খুবই ঘৃণ্য।
ভাষা-বিতর্ক : নব্যপন্থিদের ভাষার ব্যাপারে প্রাচীনপন্থিরা এ অভিমত প্রদান করেন যে, পিতাপুত্র একত্রে বসে এরূপ ভাষা ব্যবহার করা যায় না। অপরদিকে নব্যপন্থিরা বললেন যে, সংস্কৃতপ্রিয়তা এবং সংস্কৃতানুকারিতা হেতু বাংলা সাহিত্য অত্যন্ত নীরস, শ্রীহীন, দুর্বল ও অপরিচিত হয়ে রইল। বঙ্কিমচন্দ্র এ দুই পন্থিদের কারো পক্ষাবলম্বন না করে এদের সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। গ্রহণ বর্জনের সমন্বয়ে তিনি বাংলা ভাষার তৃতীয় পথ নির্দেশ করে দিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষাচিন্তা : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে সময় সাহিত্যচর্চা শুরু করেন তখন বাংলা ভাষা চিন্তাবিষয়ক উল্লিখিত দুটি ভিন্নধর্মী ধারা সাহিত্যক্ষেত্রে বিরাজ করছিল। এ দুটি ধারার বিরুদ্ধমতের ত্রুটি বিচ্যুতিসমূহকে গভীরভাবে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ব্যক্তিগত মতের ভিতটি সুদৃঢ় করে তোলেন। তিনি দুটি মতের কোনটিকেই উপেক্ষা না করে উভয়ের সমন্বয় সাধন করে নিজস্ব মতামত তুলে ধরেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের মত : বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষাচিন্তার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তিবাদিতা ও সমন্বয়ধর্মিতা। বাংলাভাষার শ্রীবৃদ্ধির বিষয়টি তিনি যুক্তির আলোকে বিচার করেছেন। প্রাচীনপন্থিদের অধিকাংশ রীতি তিনি গ্রহণ করেননি। কিন্তু নব্যপন্থিদের মতো তাঁদেরকে পরিত্যাগও করেন নি। বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধির জন্য তিনি উভয়পক্ষের যুক্তিসঙ্গত মতামত গ্রহণ করেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষ্য : ‘বিষয় অনুসারেই রচনার ভাষার উচ্চতা বা সামান্যতা নির্ধারিত হওয়া উচিত। রচনার প্রধান গুণ এবং প্রথম প্রয়োজন সরলতা এবং স্পষ্টতা। “যে রচনা সকলেই বুঝিতে পারে এবং পড়িবামাত্র যাহার অর্থ বুঝা যায়, অর্থগৌরব থাকিলে তাহাই সর্বোৎকৃষ্ট রচনা। …বলিবার কথাগুলো পরিপুষ্ট করিয়া বলিতে হইবে- যতটুকু বলিবার আছে, সবটুকু বলিবে- তজ্জন্য ইংরেজি, ফারসি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রাম্য, বন্য যে ভাষার শব্দ প্রয়োজন তাহা গ্রহণ করিবে।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলা ভাষাকে সুন্দর ও সহজ করার জন্য বঙ্কিমচন্দ্র যে যুক্তিনিষ্ঠ পরামর্শ প্রদান করেছেন- ব্যক্তিগত সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর এ ভাষাচিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধ ও উপন্যাসসমূহে তিনি একদিকে যেমন সহজবোধ্য সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেছেন অন্যদিকে প্রয়োজনীয় গ্রাম্য ও আঞ্চলিক শব্দও গ্রহণ করেছেন। তাঁর ভাষাচিন্তার বৈশিষ্ট্য হলো ভাষার সহজবোধ্যতা ও সর্বজনগ্রাহ্যতা। ভাষার দুর্বোধ্যতা ও বন্যতাকে তিনি সর্বতোভাবে পরিহারের পক্ষপাতী ছিলেন।