অথবা, বাঙালির দর্শন কী? মধ্যযুগীয় বাঙালি দর্শন সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শনের পরিচয় দাও। মধ্যযুগীয় বাঙালি দর্শনের স্বরূপ আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শন কাকে বলে? বাঙালি দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব দর্শন রয়েছে। প্রত্যেক জাতির জীবনযাত্রা, মনন ও সাহিত্যের মধ্যে তাদের দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়। আর এভাবেই গড়ে উঠেছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন গ্রিক দর্শন, ইউরোপীয় দর্শন, ভারতীয় দর্শন, মুসলিম দর্শন প্রভৃতি। প্রত্যেকটি জাতিই স্বতন্ত্রভাবে বা অপর কোনো দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজস্ব চিন্তা ও মননের সমন্বয় ঘটিয়ে নির্দিষ্ট দার্শনিক ধারা প্রবর্তন করে। অন্যান্য জাতির মতো বাঙালি জাতির প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন দার্শনিক সমস্যা সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত নিয়ে বাঙালি দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাঙালি দর্শনের ক্রমবিকাশকে সময়ের প্রেক্ষিতে তিনটি প্রধান যুগে ভাগ করা হয়েছে। প্রত্যেক যুগের দর্শনই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
বাঙালি দর্শন : ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় অন্যান্য প্রাগ্রসর জাতির মতো বাঙালির দর্শনচিন্তাও ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে। বাঙালির দর্শনের তিন যুগে (প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক) বাঙালি দর্শন বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়ে জগজ্জীবনের স্বরূপ ও গূঢ়ার্থ আবিষ্কার এবং যথার্থ মানবোচিত জীবনের অনুসন্ধানসহ মানুষকে নিয়ে মানুষের ভাবনা বাঙালির দর্শনচিন্তায় একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যরূপে দেখা দিয়েছে। তাই বলা যায়, বাঙালি দর্শন হলো বাঙালির ধ্যানধারণা, চিন্তা, মনন, ভাবধারা, মতামত, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদির সংমিশ্রণ।
বাঙালি দর্শন নিছক দুঃখবাদী কিংবা ভাববিলাসী দর্শন নয়; বাঙালি দর্শন হলো জগৎ ও জীবনের সাথে সম্পর্কিত দর্শন। তাই বলা যায়, বাংলা ও বাংলার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের বৈচিত্র্যময় রূপ ও রসের মাধুর্যে আপ্লুত হয়ে মরমি চেতনায় উদ্ভূত যে দর্শন তাকেই বাঙালি দর্শন বলে অভিহিত করা হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্নভাবে বাঙালি দর্শনকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :
বাঙালির দর্শনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ড. প্রদীপ কুমার রায় বলেছেন, “যে প্রজ্ঞাময় দর্শন বাংলাদেশের আবহমানকালের বিশাল পটভূমিতে, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এ সময় পর্যন্ত বিবর্তিত হয়েছে তাই বাঙালির দর্শন।”
অধ্যাপক সাইদুর রহমান বাঙালি দর্শন সম্পর্কে বলেন, “বাঙালি দর্শন কেবল সমদর্শন নয়, খালি পরলোক চর্চা নয়, তত্ত্ববিদ্যার নিছক রোমন্থন ও কসরত নয়, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের যে কোন সার্থক দর্শনের ন্যায় বাঙালি দর্শনও মূলত জীবনদর্শন, উন্নত মানবজীবন প্রণয়ন ও যাপনের উপায়ানুসন্ধান।”
অধ্যাপক মফিজউদ্দিন আহমেদ বাঙালি দর্শন সম্পর্কে বলেন, “বাঙালি দর্শন মুক্তি বা মোক্ষলাভকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।”
সুতরাং উপরের আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, বাঙালির দর্শন হলো বাঙালির শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তাচেতনা, মনন ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচিত জীবনদর্শন।
মধ্যযুগীয় বাঙালি দর্শন : প্রাচীন যুগে বাঙালির চিন্তাধারায় মননসাধনা ও দর্শনচর্চার যে ঐতিহ্য গড়ে উঠে তা মধ্যযুগে আরো বিকশিত হয়। প্রাচীন শাস্ত্র চর্চার পাশাপাশি এ সময় মানবতা, প্রেম, ভক্তি প্রভৃতির চর্চা করা হতো। মধ্যযুগের বাঙালি দর্শনে যুক্তি বা ন্যায়শাস্ত্র চর্চার ঐতিহ্য গড়ে উঠে। মধ্যযুগের বাঙালি দর্শনে ন্যায়শাস্ত্রের পাশাপাশি স্মৃতিশাস্ত্রকেও গুরুত্বের সাথে চর্চা করা হতো। জনৈক আধুনিক পণ্ডিত বলেন, “ষোল শতকের দিকে ন
বদ্বীপে নব্যন্যায় বা ন্যায়শাস্ত্রের ব্যাপক চর্চা হতো। আঠারো শতক পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল।” এ সময়ের যেসব দার্শনিক বা পণ্ডিতের কাছে আমরা ঋণী তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন পনেরো শতকের হরিদাস ন্যায়ালঙ্কার, জয়রাম পঞ্চানন, হরিনাম তর্কবাগীশ, গদাধর ভট্টাচার্য প্রমুখ ন্যায়পন্থি চিন্তাবিদ। নিম্নে প্রশ্নের
আলোকে মধ্যযুগের বাঙালি দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
বাঙালি দার্শনিক ও সাহিত্যিক: মধ্যযুগে যেসব বাঙালি দার্শনিক রয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের দর্শন সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
রত্ন কবি-সাহিত্যিক ও দার্শনিক জয়দেব : তিনি বাংলা ভাষা প্রভাবিত সংস্কৃত কবি। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক ও খ্যাতনামা সাহিত্যিক। তাঁর বিখ্যাত কীর্তি হলো “গীতগোবিন্দ।” বাঙালির ধাতু-প্রকৃতি ও মন মেজাজের সাথে সম্পূর্ণ সংগতি রেখে তিনি ‘গীতগোবিন্দ’ রচনা করেন। এ গ্রন্থে প্রেমতত্ত্ব ও ভক্তিতত্ত্বের উপর আলোচনা করা হয়েছে বাঙালির মনের প্রীতির আসন থেকে। তাঁর কবিতা ছিল অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী। তাঁর আদর্শ হলো সাম্য, মৈত্রী ও মানবতাবোধ; তাঁর বিশ্বাস ছিল সমন্বয়বাদী জীবনদর্শনে। মানুষকে তিনি তাঁর দর্শনের কেন্দ্রে অবস্থান দিয়েছিলেন।
বাংলার আদি কবি চণ্ডীদাস : কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দের মতো বাঙালি দর্শনের অন্যতম আর একজন সাহিত্যিক হলেন কবি চণ্ডীদাস। তিনি পদাবলি সাহিত্যের প্রবর্তন করেন, যার মধ্যে প্রেম ও ঐক্যের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। তাঁর পদাবলি সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য হলো রাধা ও কৃষ্ণের মিলনের মাধ্যমে সহজ সাধনার উদ্বোধন করা। তাঁর রচিত পদাবলিতে অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী চেতনা ফুটে উঠেছে।
দার্শনিক শ্রীচৈতন্য দেব : হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা ও বাঙালির মনন সাধনায় যার অবদান অসামান্য তিনি হলেন শ্রীচৈতন্য দেব। তিনি বাঙালিকে উপলব্ধি করান যে “জীবে ব্রহ্ম, নরে নারায়ণ।” তিনি যে দর্শন তত্ত্ব প্রচার করেন তাই তাঁর শিষ্যরা গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে রচনা করেন চৈতন্য ভাগবত, চৈতন্য চরিতামৃত, চৈতন্য মঙ্গল প্রভৃতি গ্রন্থ। এ সব গ্রন্থের মাধ্যমেই আমরা চৈতন্য দেবের দর্শন সম্পর্কে জানতে পারি। চৈতন্য প্রেমপ্রীতির উপর জোর দিয়ে ভক্তিবাদের সমন্বয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদের প্রবর্তন করেন। তাঁর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মানুষ। তাঁর হাত ধরেই বাঙালির প্রথম নবজাগরণ সংঘটিত হয়।
মধ্যযুগের সাহিত্যে দর্শনের প্রতিফলন : ইতিহাসের সুপ্রাচীন কাল থেকে যখন বাংলা ভাষা স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় নি, যখন শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান সংস্কৃত ভাষায় চর্চা করা হতো তখনো বাঙালি চিন্তাবিদরা মানবতাবাদ নিয়ে আলোচনা করতেন। বাংলা ভাষার উৎকর্ষতার সাথে সাথে বাঙালি দর্শন চর্চার দ্বার উন্মুক্ত হয়। ফলে নতুন নতুন সাহিত্য রচনায় বাঙালিরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করেন। এ সকল সাহিত্যের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয় বাঙালির দর্শন। আর তাই মধ্যযুগের দর্শন ও সমাজ সংস্কৃতির পরিচয় সে যুগের বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। এসব
সাহিত্যের মধ্যে অন্যতম হলো :
ক. মঙ্গল সাহিত্য : মধ্যযুগে বিকশিত সাহিত্যের মধ্যে অন্যতম হলো মঙ্গল সাহিত্য। মঙ্গল সাহিত্যে মধ্যযুগের মননশীলতা ও যুগ ভাবনা ফুটে উঠে। মঙ্গল সাহিত্য তিন প্রকার : মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গলে সর্পদেবী মনসার মাহাত্ম্য আলোচনা করা হয়েছে। মঙ্গল সাহিত্যের দ্বিতীয় মহিলা দেবী হলেন চণ্ডী। চণ্ডী সকলের কল্যাণসাধন করেন তাই তিনি সর্বমঙ্গল। মঙ্গল সাহিত্যের তৃতীয় পর্ব হলো ধর্মমঙ্গল সাহিত্য। শিব ও ধর্মঠাকুরকে আশ্রয় করে এ কাব্য রচিত হয়েছে। এ তিনটি মঙ্গল সাহিত্যের মাধ্যমে সে যুগের সামাজিক অবস্থা এবং চিন্তাতেনার পরিচয় পাওয়া যায়। তৎকালীন সময়ে পূজাপার্বণের পাশাপাশি মানবতারও চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায় মঙ্গল সাহিত্যে।
খ. মুসলিম সাহিত্য : মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তৃতির কারণে বাংলাতেও মুসলমানদের আগমন ঘটে। মুসলিম কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিকগণ মননসাধনা ও দর্শনচর্চা দ্বারা মধ্যযুগে বাঙালি সাহিত্য ও দর্শনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায় মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ ও ইসলামের সাম্যের বাণী দ্বারা প্রভাবিত হন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মুসলমান কর্তৃক বাংলা বিজয়ের পর তারা সাহিত্য, দর্শন ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। এভাবে তারা বাঙালির ভাবসম্পদকে সমৃদ্ধ করেন।
গ. বাঙালি মুসলমানদের তত্ত্ব সাহিত্য : মধ্যযুগের সকল সাহিত্যেই মানবকল্যাণ, জীবনের শ্রেয় এবং পরমাত্মার বা পরমসত্তার সন্ধান করা হয়েছে। বাঙালি মুসলমানদের তত্ত্বসাহিত্য এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক সমৃদ্ধ শাখা। আধুনিক পণ্ডিতগণ তত্ত্ব সাহিত্যকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা : ধর্মসাহিত্য, সুফি সাহিত্য এবং সওয়াল সাহিত্য। তত্ত্ব সাহিত্যে অধিবিদ্যা, সামাজিক অবস্থা, নৈতিকতা প্রভৃতি আলোচিত হয়েছে। ষোল শতকের শেখ ফয়জুল্লাহ, হাজী মুহাম্মদ, সৈয়দ সুলতান
, সতেরো শতকের শেখচান্দ এবং আঠারো শতকের আলী রজা ছিলেন অধ্যাত্ম দর্শনের সুপণ্ডিত। মুসলিম চিন্তাবিদরা
জীবনের ছোটো-খাটো বিষয় থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ্য দেহতত্ত্ব, বৌদ্ধ নির্বাণতত্ত্ব, সুফির ফানা ও বৈদান্তিকের অদ্বৈতবাদ প্রভৃতি পর্যালোচনা করেছেন যা বাঙালি দর্শনকে সমৃদ্ধতর করেছে।
ঘ. সুফি দর্শন তত্ত্ব : মধ্যযুগে মুসলিম তত্ত্ব সাহিত্যের অন্তর্গত সুফিতত্ত্বকে বাঙালি দর্শনের অন্যতম একটি ধারা বলে মনে করা হয়। সুফি দর্শনের মূল্যবান গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ফয়জুল্লাহর গৌরক্ষ বিজয়, সৈয়দ সুলতানের জ্ঞান প্রদীপ জ্ঞান চৌতিষা, হাজী মুহাম্মদের সুরতনামা, শেখচান্দের হরগৌরী সম্বাদ ও তালিবনামা এবং আলী রজার আগম ও জ্ঞানসাগর প্রভৃতি। এসব গ্রন্থে জগজ্জীবন, জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য সম্ভাবনা, মুক্তি প্রভৃতি সম্পর্কে আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণা বিবৃত হয়েছে। মধ্যযুগের ধর্মীয় যুক্ত সাধনার ক্ষেত্রে সুফিবাদের অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সুফিদের দর্শন ছিল জীবনবাদী। মধ্যযুগের বাঙালি চিন্তাচেতনার উন্নয়নে সুফিবাদের অবদান অনস্বীকার্য।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি, মধ্যযুগের বাঙালি দর্শনে প্রাচীন যুগের সংস্কৃত উৎস থেকে সংগৃহীত দর্শন তত্ত্ব নবরূপে বিকশিত হয়েছে। মুসলিম অমুসলিম দার্শনিকবৃন্দ মানবতাবাদী প্রেম ও ভক্তিমূলক দর্শন চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। মধ্যযুগের দর্শন বাঙালির ইতিহাস ও নিছক ভাববিলাসের ইতিহাস নয়। এ সময় চর্চা করা হয়েছে প্রেম ধর্ম, মুক্তির উপায়, মানবকল্যাণের উপায় প্রভৃতি। মধ্যযুগের দর্শন শুধু দর্শন নয়, এ দর্শন জীবনদর্শন। বাঙালি দার্শনিকদের দর্শনের ঐতিহ্য যুক্তিবাদী দর্শনের ঐতিহ্য, যার ফলশ্রুতিতে উনিশ শতকের নবজাগরণ সংঘটিত হয়েছে। মধ্যযুগের দর্শন বাঙালি দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ স্তর বলে মনে করা হয়।