অথবা, বাঙালি দর্শনে সনাতন ধর্মের কোন কোন গ্রন্থ প্রভাব বিস্তার করেছে এবং কিভাবে? বর্ণনা কর।
অথবা, ‘সনাতন ধর্মগ্রন্থ বাঙালি দর্শনে প্রভাব বিস্তার করেছে’- উক্তিটির সপক্ষে আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শন কিভাবে সনাতন ধর্মের প্রধান প্রধান ধর্মগ্রন্থ দ্বারা প্রভাবিত তা আলোচনা কর।
উত্তর৷। ভূমিকা : বাঙালির দর্শনচিন্তার ইতিহাস অতিপ্রাচীন। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি বিজাতি ও বিদেশি শাসন কর্তৃক শাসিত হলেও নিজস্ব মননসাধনার ব্যাপারে সে সবসময়ই ছিল স্বতন্ত্র।বাঙালি দর্শনে বিভিন্ন জাতির চিন্তাধারার প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রত্যেক চিন্তাধারার সাথে বাঙালি তার নিজস্ব চিন্তার সমন্বয় করে নিজস্ব দর্শন গড়ে তুলেছে। তাই বাঙালি দর্শনে বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শন চিন্তা স্থান দখল করে আছে। বাঙালি দর্শনের প্রাচীন ও মধ্যযুগে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বাঙালি দর্শনে প্রভাব বিস্তারকারী ধর্মগ্রন্থের মধ্যে বেদ, গীতা, মহাভারত, পুরাণ, উপনিষদ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বাঙালি দর্শন : ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় অন্যান্য প্রাগ্রসর জাতির মতো বাঙালির দর্শনচিন্তাও ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে। বাঙালির দর্শনের তিন যুগে (প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক) বাঙালি দর্শন বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়ে জগজ্জীবনের স্বরূপ ও গুঢ়ার্থ আবিষ্কার এবং যথার্থ মানবোচিত জীবনের অনুসন্ধানসহ মানুষকে নিয়ে মানুষের ভাবনা বাঙালির দর্শনচিন্তায় একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যরূপে দেখা দিয়েছে। তাই বলা যায়, বাঙালি দর্শন হলো বাঙালির ধ্যানধারণা, চিন্তা, মনন, ভাবধারা, মতামত, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদির সংমিশ্রণ।
বাঙালি দর্শন নিছক দুঃখবাদী কিংবা ভাববিলাসী দর্শন নয়; বাঙালি দর্শন হলো জগৎ ও জীবনের সাথে সম্পর্কিত দর্শন। তাই বলা যায়, বাংলা ও বাংলার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের বৈচিত্র্যময় রূপ ও রসের মাধুর্যে আপ্লুত হয়ে মরমি চেতনায় উদ্ভূত যে দর্শন তাকেই বাঙালি দর্শন বলে অভিহিত করা হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্নভাবে বাঙালির দর্শনকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :
বাঙালির দর্শনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ড. প্রদীপ কুমার রায় বলেছেন, “যে প্রজ্ঞাময় দর্শন বাংলাদেশের আবহমানকালের বিশাল পটভূমিতে, প্রাগৈতিহাসিক কাল হলে এ সময় পর্যন্ত বিবর্তিত হয়েছে তাই বাঙালির দর্শন।”
অধ্যাপক সাইদুর রহমান বাঙালি দর্শন সম্পর্কে বলেন, “বাঙালি দর্শন কেবল সমদর্শন নয়, খালি পরলোক চর্চা নয়,তত্ত্ববিদ্যার নিছক রোমন্থন ও কসরত নয়, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের যে কোনো সার্থক দর্শনের ন্যায় বাঙালি দর্শনও মূলত জীবনদর্শন, উন্নত মানবজীবন প্রণয়ন ও যাপনের উপায়ানুসন্ধান।”
অধ্যাপক মফিজউদ্দিন আহমেদ বাঙালি দর্শন সম্পর্কে বলেন, “বাঙালি দর্শন মুক্তি বা মোক্ষলাভকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।”
সুতরাং উপরের আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, বাঙালির দর্শন হলো বাঙালির শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তাচেতনা, মনন ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচিত জীবনদর্শন।
বাঙালি দর্শনে প্রভাব বিস্তারকারী সনাতন ধর্মগ্রন্থসমূহ: পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা, দর্শন ও সংস্কৃতির উৎসভূমি হলো বৈদিক সাহিত্য। বৈদিক সাহিত্যই সনাতন ধর্মের মূল উৎসরূপে পরিগণিত হয়। বৈদিক সাহিত্য মানুষের সৃষ্টি, তার আত্মিক, মানবিক ও নৈতিক দিকসহ সমগ্র মানব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধর্মীয় ধ্যানধারণার উদ্ভব হয়েছে। সনাতন ধর্মের মূল উৎস হলো বৈদিক সাহিত্য। নিম্নে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থ ও বাঙালি দর্শনে তার প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
বেদ
: বেদ হলো বৈদিক সাহিত্যের মূল গ্রন্থ। অর্থাৎ বৈদিক সাহিত্যের মূল উপাদান ও সুসংহত রূপ হলো বেদ। বেদে মানব পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। মানবজীবন, জীবের উৎপত্তি, বিকাশ ও পরিণত্তি, লক্ষ্য প্রভৃতি সম্পর্কিত আলোচনা বাঙালি সমাজ ও চিন্তাজগতে প্রভাব বিস্তার করে এবং তা বাঙালি দর্শনের অন্যতম উপাদান হিসেবে গৃহীত হয়। বেদের চারটি খণ্ডে (ঋগ, সাম, যজুঃ ও অথব) মানবপ্রকৃতির স্বরূপ ও মুক্তির পথ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বেদে সৃষ্টি তত্ত্বেরও ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। নৈতিক জীবনকে পরিপূর্ণ করে আদর্শ মানবে পরিণত করার জন্য। বেদে অনেক বিধান রয়েছে। জীবনের পরম লক্ষ্য ও তা অর্জনের উপায় সম্পর্কেও এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বাঙালি দর্শন চর্চা বলতে যা কিছু বুঝায় তা বেদের দর্শন থেকে হয় উৎসারিত না হয় প্রভাবিত।
উপনিষদ : বেদের সর্বশেষ পর্যায় হলো উপনিষদ। বেদের যাবতীয় দার্শনিক আলোচনাকে কেন্দ্র করে ঋষিমুনি, সাধু-সন্ন্যাসী, যোগী-তপস্বী ও ত্রিকালদর্শী সাধকগণ উপনিষদ রচনা করেন। উপনিষদ্ দার্শনিক আলোচনায় পরিপূর্ণ গ্রন্থ। উপনিষদের সংখ্যা অসংখ্য, তবে বেদের সাথে সংযুক্ত উপনিষদ হিসেবে সাতটি উপনিষদের নাম জানা যায়। উপনিষদের যাবতীয় আলোচনার মূলে মানুষের অবস্থান। মানুষের স্বরূপ, লক্ষ্য ও পরিণতি সম্পর্কে উপনিষদের আলোচনা তাৎপর্যপূর্ণ। বাঙালি দর্শনকে উপনিষদ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। দার্শনিক ও সমালোচক খ্যাত ব্লুমফিল্ড বলেন, উপনিষদের ভিত্তিতে গঠিত নয়, এমন কোন সারবান হিন্দু মত নেই; এমনকি বৌদ্ধদর্শন যদিও বেদ বিরোধী তবু তার সম্বন্ধেও এ কথা বলা যায়।” উপনিষদের দর্শনচিন্তা প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাঙালি দর্শনকে সর্বাধিক প্রভাবিত করে।
রামায়ণ : বেদ ও উপনিষদের পরে রামায়ণ মহাকাব্যের দ্বারা বাঙালি দর্শন প্রভাবিত হয়েছে। রামায়ণে নানা অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত ঘটনা বা অবস্থা এবং অতীন্দ্রিয় উপমা দ্বারা মানব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। রামায়ণ আশাবাদী মতবাদ প্রচার করে মানুষকে নৈরাশ্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে। রামায়ণে মানবজীবনের ত্রিবিধ লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। যথা: ধর্ম, অর্থ এবং কাম। একত্রে এদের ত্রিবর্গ বলা হয়। নৈতিকতার সপক্ষে রামায়ণে মানুষকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মানুষের স্বরূপ ব্যাখ্যায় রামায়ণে বর্ণিত হয়েছে- পারলৌকিক কল্যাণ। শিষ্টলোকের অনুমোদন, অন্যলোকের নীতির উপর প্রভাব এবং নিজের সদাসদ বিবেকবুদ্ধি ও আত্মসম্মান এ নীতি জিজ্ঞাসার মাধ্যমেই মানুষ সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা লাভ করা যায়। রামায়ণের অচলাভক্তি, নীতি জিজ্ঞাসা, সত্য বিশ্বাস প্রভৃতি দ্বারা বাঙালি দর্শন প্রভাবিত হয়েছে। রামায়ণে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গির নির্দেশনাও রয়েছে যা বর্তমান নারীবাদের সূচনা বলা যেতে পারে।
মহাভারত : মানবপ্রকৃতি ব্যাখ্যায় মহাভারত হলো রত্নভাণ্ডার স্বরূপ। মহাভারতের যাবতীয় আলোচনা মানব প্রকৃতির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ কেন্দ্রিক। মহাভারতে মানুষের জীবনের সকল দিক সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ঐহিক ও পারলৌকিক সকল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মহাভারতে মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মহাভারতে সমাজের সার্বিক কল্যাণের কথা বা সমগ্র মানবতার কল্যাণের কথা বলা হয়েছে। মহাভারতে মানুষের স্বরূপ গঠনে সত্ত্ব, রজ ও তম এ তিনটি গুণের উপস্থিতি স্বীকার করা হয় যা মানুষের প্রকৃতি বা চরিত্র নির্ধারণ করে। কর্মবাদে বিশ্বাস মহাভারতের অপর একটি বৈশিষ্ট্য। ধর্মের মাধ্যমেই চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। মহাভারতে মোক্ষ সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। বাঙালি পণ্ডিতগণ এসব বিষয়ের উপর অনেক টীকা ভাষ্য রচনা করেছেন এবং তত্ত্ব প
্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রাচীন গ্রন্থ মহাভারতের বিষয় দ্বারা বাঙালি দর্শন প্রভাবিত হয়েছে।
শ্রীমভগবদগীতা : মানবপ্রকৃতি ও মানবত্মার রহস্য ব্যাখ্যায় গীতিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই সনাতন ধর্ম ও বাঙালি দর্শনে বিবেচনা করা হয়। গীতায় মানবপ্রকৃতির গতি, প্রকৃতি, লক্ষ্য ও পরিণতি যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বাঙালি দর্শনে তার প্রভাব অস্বীকার করার সুযোগ নেই। গীতার ভক্তি অপেক্ষা কর্মের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে কিন্তু ভক্তিযোগ ও জ্ঞানযোগকে উপেক্ষা করে নয়। গীতায় মোক্ষ লাভের জন্য জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির পথ অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। গীতাকে বাঙালি দর্শনের অন্যতম উৎস বলে বিবেচনা করা হয়। গীতায় বর্ণিত আদর্শ হলো সমন্বয়ধর্মী। এ আদর্শ অনুসরণ করতে ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ করতে হয়। গীতার শিক্ষা বাঙালির ধর্ম ও দর্শনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
পুরাণ : সনাতন ধর্মের অন্যতম একটি ধর্মগ্রন্থ হলো পুরাণ। ভারতীয় ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতির ইতিহাসে পুরাণ অন্যতম প্রাচীন শাস্ত্র। পুরাণে মানবজীবনের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অনেকে পুরাণকে প্রাচীন ও মধ্যযুগে হিন্দুধর্মের ধর্মীয়, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক গ্রন্থকোষ হিসেবে অভিহিত করেছেন বা গ্রহণ করেছেন। পুরাণের সৃষ্টিতত্ত্ব, নির্গুণ ঈশ্বর, জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভেদাত্মক সম্পর্ক মানুষের স্বরূপের ব্যাখ্যা, মানবকল্যাণ প্রভৃতি দ্বারা বাঙালি দর্শন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। বাঙালি তত্ত্বদর্শনে পুরাণের অনেক ধ্যানধারণা স্থান লাভ করেছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি, সনাতন ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ বাঙালি দর্শনচিন্তার প্রাথমিক স্তর থেকেই প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে। বাঙালি দর্শনের সূচনা হয়েছে এসব ধর্মীয় গ্রন্থের অঙ্গীভূত বিভিন্ন তত্ত্ব আলোচনার মধ্য দিয়ে। এসব সনাতন ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যার প্রয়াস থেকে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে এবং প্রাচীন বাঙালি চিন্তাবিদ ও মনীষীগণ এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দাঁড় করান। আর এভাবেই বাঙালি দর্শন স্বতন্ত্র দর্শন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাঙালি দর্শন এসব সনাতন ধর্মগ্রন্থের কাছে ঋণী। বাঙালি দর্শনকে বুঝতে এসব ধর্মগ্রন্থে আলোচিত বিষয়াবলি সম্পর্কে জানা দরকার। সুতরাং এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাঙালি দর্শন সনাতন ধর্মগ্রন্থ দ্বারা প্রভাবিত দর্শন।