অথবা, “বাঙালি দর্শনে অবৈদিক উপাদান প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে”-উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শনে প্রভাব বিস্তারকারী অবৈদিক উপাদান সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শন যে সব অবৈদিক উপাদান দ্বারা প্রভাবিত সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর৷। ভূমিকা : ইতিহাস অনুসন্ধান করলে জানা যায় যে, অন্যান্য অগ্রসরমান জাতির মতো প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির দর্শনচিন্তা অব্যাহতভাবে বিভিন্ন যুগে বিকশিত হয়েছে। জগৎ ও জীবনের স্বরূপ ও গূঢ়ার্থ-আবিষ্কার এবং মানুষকে নিয়ে মানুষের ভাবনা থেকেই বাঙালি দর্শনচর্চার সূত্রপাত হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের চিন্তাধারায় বেদ সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করেছে। এছাড়াও বেদ বহির্ভূত অনেক উপাদান রয়েছে যা প্রাচীনকাল থেকেই উপমহাদেশ তথা বাঙালি চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছে। তাই পণ্ডিতগণ বা দার্শনিকগণ মনে করেন বাঙালি দর্শনে তথা বাঙালির চিন্তায় আর্যপূর্ব অবৈদিক প্রভাব সুস্পষ্ট যার কিছু কিছু আজও টিকে আছে বাঙালি ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতির পালাবদলের মধ্যেও।
বাঙালি দর্শনে প্রভাব বিস্তারকারী অবৈদিক উপাদানসমূহ : বাঙালি দর্শনে যেসব অবৈদিক উপাদান প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে তাকে আর্যপূর্ব অবৈদিক প্রভাব বলে অভিহিত করা হয়। বাঙালি দর্শনে প্রভাব বিস্তারকারী অবৈদিক উপাদানকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে পারি। যথা :
১. তন্ত্র সম্পর্কিত মতবাদ;
২. শৈব মতবাদ বা মত ও
৩. শাক্ত মতবাদ ।
১. তন্ত্র সম্পর্কিত মতবাদ : সাধারণত যে শাস্ত্র অনুযায়ী সাধন করলে জীবের মোক্ষ বা মুক্তি লাভ হয় তাকেই তন্ত্র বলে। তন্ত্রে তত্ত্ব ও মন্ত্রের সমন্বয়সাধন করা হয়। বেদের বহু পূর্বেই তন্ত্রের উৎপত্তি ঘটেছে বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন। আর্যপূর্ব দ্রাবিড় জাতির মধ্যে তন্ত্রের ব্যবহার ছিল। বেদের মতোই তন্ত্রকে স্মৃতিতে ধারণ করা হতো এবং মুখে মুখে লোক পরম্পরায় তন্ত্র গীত হতো। প্রাচীনকাল থেকেই তন্ত্র জনপ্রিয় ছিল। পরবর্তীতে সম্প্রদায় ভেদে দুই ধরনের তন্ত্র সাহিত্য গড়ে উঠে। যথা :
ক. হিন্দু তন্ত্র ও
খ. বৌদ্ধ তন্ত্র।
ক. হিন্দু তন্ত্র : আনুমানিক সপ্তম শতকের পূর্বে হিন্দু তন্ত্র রচিত হয়েছিল বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন। তন্ত্রের মধ্যে হিন্দু তন্ত্রই প্রাচীন। হিন্দু তন্ত্র শিবোক্ত শাস্ত্র নামেও পরিচিত। বাঙালি সমাজে ব্যাপক হারে তন্ত্রের প্রচলন ছিল। হিন্দু তান্ত্রিক সাধকগণ সাধনার জন্য তান্ত্রিক পথ অনুসরণের জন্য নির্দেশনা দিতেন। এজন্য গুরুর নিকট দীক্ষা গ্রহণের আবশ্যিকতাকে অস্বীকার করার সুযোগ ছিল না। হিন্দু তন্ত্রকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা :
i. শৈব তন্ত্র;
ii. শাক্ত তন্ত্র ও
iii. বৈষ্ণবীয় তন্ত্র।
হিন্দু তন্ত্রের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। হিন্দু তন্ত্রের সংখ্যা মূলত অসংখ্য। এ পর্যন্ত আমরা যেসব তন্ত্রের সন্ধান পাই তার মধ্যে সায়দালিতক, যোগিনীতন্ত্র, বারাহীতন্ত্র, বিশ্বসারতন্ত্র, দুর্গাডামর, রুদ্রযামল, তন্ত্রসার, সরস্বতীতন্ত্র, কামাখ্যাতন্ত্র প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব তন্ত্র সংস্কৃত ভাষায় রচিত হলেও বাঙালি দর্শনে সক্রিয় প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে।
খ. বৌদ্ধ তন্ত্র : বাংলায় বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বৌদ্ধ তান্ত্রিকতার প্রবর্তন করেন।বৌদ্ধ সহজযান সম্প্রদায়ের প্রবর্তক হলেন লুইপা বা সিদ্ধাচার্য। তিনি বাঙালি এবং বাংলা ভাষাতেই অনেক দোহা গান রচনা করেন। এছাড়া বাঙালি দার্শনিক ও বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম প্রচার করে বিখ্যাত হয়ে আছেন। বৌদ্ধতন্ত্রের উপর রচিত প্রথম গ্রন্থ হলো “গুহ্যসমাজ তন্ত্র” । এছাড়া রয়েছে
অদ্বয়বজ্রসংগ্রহ, নিষ্পেন্নযোগাবলী, সাধনমালা, হেবজ্র, বারোহীকল্প, মরীচিতন্ত্র, উড্ডামরতন্ত্র, ক্রিয়াসার, মঞ্জুশীতন্ত্র, প্রমোদমহাযুগ, কৌলঞ্জান নির্ণয় প্রভৃতি।বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদেও বৌদ্ধ তন্ত্রের চিন্তাধারার প্রভাব দেখা যায়। তাই বাঙালি দার্শনিকদের চিন্তাভাবনায় হিন্দু তন্ত্রের পাশাপাশি বৌদ্ধ তন্ত্রের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। বাংলায় বৌদ্ধধর্মের মন্ত্রযান, বজ্রযান,সহজযান ও কালচক্রযান নামক মতবাদের ভিত্তি হিসেবে বৌদ্ধ তান্ত্রিক তাই কাজ করেছে।
২. শৈব মতবাদ : পুরুষ দেবতার প্রতীক অবৈদিক দেবতা শিবের আরাধনা থেকেই শৈব মতবাদের উদ্ভব হয়েছে। প্রাচীন সমাজে উৎপাদনের সাথে সংগতি রেখে নারী ও পুরুষের লিঙ্গকে প্রতীকীভাবে আরাধনা থেকে শিবলিঙ্গ পূজার রীতি চালু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান বাঙালি সমাজেও শিবের গীত, শিবলিঙ্গের পূজার্চনার রীতি লক্ষ করা যায়।শৈব মত দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে একেশ্বরবাদী, কেননা এখানে শিবকেই ব্রহ্ম বলে স্বীকার করা হয় এবং শিব একই সাথে জগৎ ও জগতের অতীত। শিব ও শক্তি একই সত্তার দুটি দিক। প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে গড়ে উঠা বিভিন্ন নগর সভ্যতায় শৈব মূর্তি আবিষ্কার হওয়ায় এ মতবাদ জনপ্রিয় ছিল বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা নগরীতে প্রাপ্ত শিবলিঙ্গ ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে। শৈব ধর্মে ভক্তিবাদকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং এর লৌকিক দিক অত্যন্ত জনপ্রিয় বলেই প্রতীয়মান হয়। শৈবধর্ম তন্ত্র ও সাংখ্যতত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ধর্ম। প্রাচীন কালেই বাংলায় শৈব ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল। পাহাড়পুরে প্রাপ্ত ফলক থেকে আমরা বাংলায় শৈব ধর্মের প্রসার ও প্রতিপত্তির প্রমাণ পাই।বর্তমান সময়েও বাঙালি ধর্ম চিন্তায় শৈবধর্ম একটি বিশেষ স্থান লাভ করে রয়েছে।
৩. শাক্ত মতবাদ : প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় শাক্ত মতবাদ প্রচলিত আছে যেখানে নারীকে সর্বোচ্চ দেবী হিসেবে গ্রহণ করে তাঁর আরাধনা ও পূজার্চনা করা হয়। বাংলাদেশ তথা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে শাক্ত মতবাদ একটি প্রতিষ্ঠিত মতবাদ। খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতক হতে বাঙালি সমাজে শাক্ত ধর্ম বা মতবাদ সর্বাধিক প্রসার লাভ করে। এ সময়ে অতীতের ধারাবাহিকতায় বাঙালি সমাজে দুর্গা দেবীর পূজা, কালীপূজা, চণ্ডীপূজা, মনসাপূজা, লক্ষ্মী দেবীর পূজার্চনা ব্যাপকভাবে শুরু হয়। পণ্ডিতগণ মনে করেন, বাঙালি সমাজে প্রাচীনকাল থেকে মাতৃতান্ত্রিকতার প্রাধান্য থাকায় বাঙালিদের মধ্যে মাতৃদেবতার এবং মাতৃ উপাসনার রীতি গড়ে উঠে। বাঙালি হিন্দুসমাজে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে শাক্ত মতবাদ।বিভিন্ন রাজবংশের শাসনামলে শাক্ত মতবাদের বিকাশে বিভিন্ন ধারার সংমিশ্রণ ঘটে। তবে বাঙালি সমাজে শাক্ত মতবাদ বা মাতৃদেবীর পূজা ও শক্তি সাধনার কোনো তারতম্য ঘটে নি। বাঙালি সমাজে প্রচলিত এসব শক্তি পূজার গূঢ়ার্থ ও দার্শনিকতা পরবর্তী কালে বাঙালি দর্শনের অন্যতম দুটি ধারা বাউল ও বৈষ্ণব দর্শনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি, বাঙালি দর্শনচিন্তায় আর্যপূর্ব অনেক বিষয়ের সমন্বয় ঘটেছে। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা থেকে বাঙালির সমাজ, ধর্ম ও দর্শন ভাবনায় প্রভাব বিস্তারকারী অবৈদিক উপাদানের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এমনকি বৈদিক উপাদানেও আর্য পূর্ববর্তী চিন্তাধারার প্রভাব রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। মূলত আমাদের সমাজদর্শন, ধর্মদর্শন সবই বাংলার আদিমতম (অবৈদিক) জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার দ্বারা প্রভাবিত। তাই বাঙালি দর্শনে অবৈদিক উপাদানের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না।