অথবা, “বাঙালি দর্শনের বিকাশে উপনিষদের অসামান্য অবদান রয়েছে”-উক্তিটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷। ভূমিকা : বাঙালি দর্শন অতি প্রাচীন দর্শন। অন্যান্য অগ্রসরমান জাতির মতো বাঙালির দর্শনচিন্তাও ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ভাবে বিকশিত হয়েছে। বাঙালি দর্শনের বিকাশে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী ধর্মীয় গ্রন্থ হলো বেদ। বেদের যাবতীয় দার্শনিক আলোচনা স্থান পেয়েছে বেদের সর্বশেষ পর্যায় উপনিষদে। উপনিষদ হলো ভারতীয় ঋষিমুনি, সাধু-সন্ন্যাসী ও যোগী-তপস্বী তথা ক্রান্তদর্শী মনীষীদের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি।
বাঙালি দর্শনে উপনিষদের প্রভাব বা উক্তিটির ব্যাখ্যা : গুরুর সামনে উপবিষ্ট হয়ে বসে শিষ্য যে বিদ্যার্জন করে তাকে উপনিষদ বলে। কাহিনী, ব্যাখ্যা, আখ্যান, উপাখ্যান, উপদেশ, অনুব্যাখ্যা, ঘরোয়া আলাপ-আলোচনা ও কথোপকথনের আকারে উপনিষদে বেদের দার্শনিক আলোচনা করা হয়েছে। বাঙালি দর্শনে এর প্রভাব নিম্নরূপ:
১. বাঙালি দর্শনে উপনিষদের মর্যাদা : বাঙালি দর্শনে উপনিষদ একটি ধর্মগ্রন্থ হিসেবেই পরিচিত। তবে উপনিষদ দার্শনিক আলোচনায় ভরপুর। সত্যদ্রষ্টা ঋষিমুনি, সাধু-সন্ন্যাসী ও যোগী তপস্বীদের অনন্য সৃষ্টি এ উপনিষদের আলোচনা বাঙালি দর্শনের অন্যতম উপজীব্য বিষয়।
২. মানবমনের স্বরূপ অনুসন্ধান : উপনিষদের যাবতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষের অবস্থান। মানুষ কী,মানুষের সারধর্ম কী, পরিণতি, উদ্দেশ্য, অস্তিত্বের সত্যতা প্রভৃতি বিষয় উপনিষদের আলোচনার মৌলিক বিষয়। মানবমনের এরূপ উপনিষদীয় সমীক্ষা বাঙালি দর্শনেও লক্ষ করা যায়।
৩. মানবাত্মা ও ব্রহ্মের সম্পর্ক : উপনিষদের ঋষিরা মানবাত্মাকে ব্রহ্মের সমার্থক বলে মনে করেন। মানবাত্মা ব্রহ্মের মতই শাশ্বত ও চিরন্তন। ছান্দোগ্য উপনিষদে আত্মা ও ঈশ্বর/ব্রহ্ম সমার্থক বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ঐতরেয়সহ অন্যান্য কয়েকটি উপনিষদেও আত্মা ও ব্রহ্মের অভিন্নত্ব ঘোষিত হয়েছে।
৪. দেবতা, অসুর এবং মানব : বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেবতা, অসুর ও মানব- এ তিন শ্রেণির জীবকে যথাক্রমে দয়ধম, দাস্যত ও দত্ত নামে তিনটি অনুশাসন দেয়া হয়েছে। তবে যিনি ব্রহ্মের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরেছেন তিনি সকল নিয়মের ঊর্ধ্বে।
৫. কর্ম, মোক্ষ ও আত্মার মুক্তি : ‘কর্মের উপরে ফল নির্ভর করে’ এটাই কর্মবাদের মূলকথা। আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারাই আত্মার মুক্তি। শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন এর মাধ্যমে জন্মান্তরের চক্র থেকে মুক্তিই আত্মার মুক্তি। আত্মাকে উপলব্ধি করার মানেই হলো ব্রহ্মকে লাভ করা। আর ব্রহ্ম লাভ করলে মোক্ষ লাভ হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, উপনিষদের চিন্তাধারা বাঙালি দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। উপনিষদের চিন্তাবিদ বা পণ্ডিতগণের মধ্যে অনেক বাঙালি ভাষ্যকারের নাম জানা যায়।উপনিষদ হতে বাঙালি দর্শন বহু বিষয় গ্রহণ করে বাংলা সমাজ ও দর্শনে অবদান রেখেছেন। তাই বাঙালি দর্শন বিকাশে উপনিষদের অবদান অস্বীকার করা যায় না।