অথবা, বাঙালি দর্শনের তিনটি যুগ আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শনের বিভিন্ন যুগ-বিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, “বিভিন্ন যুগে বাঙালি দর্শনের প্রকৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়”- উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শনের যুগবিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : হিমালয়ের দক্ষিণ পাদদেশে ভাটির অঞ্চলটি ‘বাঙল’ নামে পরিচিত। এ অঞ্চলের অধিবাসীগণ বাঙালি নামে খ্যাত। বাংলা সাহিত্যের আদিম অবস্থা অনেকটা কুয়াশাচ্ছন্ন। সঠিক উপাদান এবং সুনিশ্চিত যুক্তি প্রমাণের অভাবে এ বিষয়ে আজও পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। এ প্রতিকূল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও বাঙালি দর্শন কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী । বাঙালি দর্শনের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
প্রাচীন যুগ : বাংলাদেশের প্রাচীন অধিবাসীরা ‘অনার্য’ বলে পরিচিত। অনার্য বাঙালিরাই এ দেশে দার্শনিক চিন্তাধারার বীজ বপন করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর বক্তব্যে অনার্যদের সম্পর্কে এ মন্তব্যের অনেকটা সত্যতা মিলে।
১. বস্তুবাদী চিন্তাধারা : লোকায়ত দর্শন হলো বস্তুবাদী দর্শন। লোকায়িতরা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণকে জ্ঞানের একমাত্র উৎস মনে করতেন। তাঁরা মনে করতেন যে, প্রত্যক্ষ পরায়ণতা ধর্ম প্রবঞ্চনার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
২. ভাববাদী চিন্তাধারা : প্রাগৈতিহাসিক ও প্রাচীন বাংলাদেশে জড়বাদ ও অধ্যাত্মবাদ উভয় মতবাদই প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে আর্যদের আগমনের পর এখানে বস্তুবাদ ও ভাববাদ উভয় মতবাদই বিকাশ লাভ করে।
৩. অন্যান্য দার্শনিক মতের প্রভাব : তাছাড়া মহর্ষি গৌতম প্রতিষ্ঠিত ন্যায় দর্শন, ঋষি কনাদের বৈশেষিক দর্শন, মহর্ষি কপিলের সাংখ্য দর্শন, মহর্ষি পতঞ্জলীর যোগ দর্শন, মহর্ষি জৈমিনির মীমাংসা দর্শন বাংলাদেশে উদ্ভূত না হলেও এসব দর্শনের অনুশীলন এখানে কম হয় নি। ফলে বাঙালির চিন্তাধারা ৱিকাশে এসব দর্শন যে প্রভাব রেখেছে, তা সহজেই অনুমেয়।
মধ্যযুগ : বাংলাদেশে মধ্যযুগে ইসলামি, বৈষ্ণবীয় এবং বাউল দর্শন বিস্তার লাভ করে।
১. ইসলামি প্রভাব : আরব বিশ্বের সাথে যোগাযোগের ফলে মধ্যযুগে বাংলাদেশে ইসলামিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে। অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে যে সুফিসাধকরা এ দেশে এসেছিলেন তা অনেকেই স্বীকার করে। আবার ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে এ দেশে ইসলামিক ভাবধারার যে অনুপ্রবেশ ঘটেছে; তা আজ বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
২. বৈষ্ণবীয় প্রভাব : শ্রী চৈতন্যদেব ষোড়শ শতাব্দীতে আশ্রম ছেড়ে বের হয়ে রাজপথে প্রচার করলেন প্রেম দর্শন,গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদ, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, শূদ্র, চণ্ডাল এককথার আপামর হিন্দুসমাজের স্বমহিমায় বিস্ময়কর জাগরণের ফলে বাঙালি হিন্দুসমাজ লাভ করল এক অভিনব শক্তি ও চিন্তাচেতনা।
৩. বাউল প্রভাব : চৈতন্যোত্তরকালে সুফি দর্শন ও গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের প্রভাবের ফলে বাংলার মাটিতে আত্মপ্রকাশ করল আরও একটি মানবতাবাদী তত্ত্ব, যা বাউল তত্ত্ব নামে পরিচিত। সপ্তদশ শতাব্দীতে বাউল তত্ত্ব আত্মপ্রকাশ করলেও বাঙালি সমাজে এর প্রভাব আজও বিদ্যমান।
আধুনিক যুগ : আধুনিক যুগে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব বাঙালির চিন্তাধারায় সংযোজন ঘটে। এগুলোর মধ্যে প্রত্যক্ষবাদ, উপযোগবাদ ও মার্কসবাদ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
১. যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদী প্রভাব : আধুনিক যুগে বাংলায় ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁতের প্রত্যক্ষবাদ অনুপ্রবেশ করে। যেসব বাঙালি চিন্তাবিদ সরাসরি প্রত্যক্ষবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হন, তাঁদের মধ্যে যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ (১৮৪২-১৯০২), ‘বাঙালি’ পত্রিকার সম্পাদক
গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮১৪-১৮৮২), কলকাতা হাই কোর্টের বিচারক দ্বারকানাথ মিত্র (১৮৩৩-১৮৭৯) এবং রাম কমল ভট্টাচার্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
২. উপযোগবাদের প্রভাব : ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা রেনেসাঁ আন্দোলনের অনেক চিন্তাবিদই উপযোগবাদ দ্বারা প্রভাবিত হন। এঁদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২১-১৮৮৬), কেশব চন্দ্র সেন (১৮৩৩-১৮৮৪) প্রমুখ অন্যতম। উপযোগবাদ তৎকালীন বাংলায় একদল তরুণকেও বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এরা হলেন ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের
৩. উদারতাবাদের প্রভাব : উপযোগবাদী নীতি অনুসরণে এ দেশে যে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তিত হয়েছিল, তার প্রভাব দেরিতে হলেও এ দেশের মুসলিম সমাজের উপর পড়ে। অনেক মুসলিম মনীষীই বুদ্ধিভিত্তিক এ উদারনীতির অনুসরণে এগিয়ে এসেছিলেন। এদের মধ্যে নবাব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হোসেন, আবদুল হক, আবদুল কাদির, আবুল ফজল ও কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ বুদ্ধিজীবী উল্লেখযোগ্য।
৪. মার্কসীয় প্রভাব : ১৯২০ এর দশকে বাংলায় মার্কসীয় দর্শনের আগমন দেশজ তত্ত্ব ধারায় এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। সর্বোপরি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন হতে প্রেরিত মার্কসবাদ-লেলিনবাদ-মাওবাদ এর উপর মূল পুস্তকাদি যে এ দেশে মার্কসীয় দর্শন প্রচারে এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলা ভাষাভাষী ভূখণ্ডে প্রাচীনকাল হতে আজ পর্যন্ত যেসব ভাবধারার উন্মেষ, অনুপ্রবেশ ও অনুশীলন ঘটেছে তার সবই যথার্থ অর্থে দর্শন নয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধর্ম বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে, ধর্মে খোঁজা হয়েছে জগৎ ও জীবন বিষয়ক নানা প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু আধুনিক যুগে ধর্মের নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীন চিন্তার মাধ্যমে দর্শন চর্চা করা হয়েছে। এ অর্থে বাঙালি দর্শনের আধুনিক যুগকে প্রকৃত অর্থে দর্শন বলা চলে।