অথবা, বাঙালি দর্শনে জৈনধর্মের প্রভাব লিখ।
অথবা, বাঙালি দর্শনের উপর জৈন ধর্মতত্ত্বের প্রভাব কীরূপ?
অথবা, জৈনধর্ম কিভাবে বাঙালি দর্শনকে প্রভাবিত করেছে?
অথবা, বাঙালি দর্শনে জৈনধর্মের প্রভাব ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : বাঙালি দর্শনচিন্তার ইতিহাস অতি প্রাচীন। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি বিজাতি ও বিদেশি শাসন কর্তৃক শাসিত হলেও নিজস্ব মনন সাধনার ব্যাপারে তারা ছিল সবসময় স্বতন্ত্র। বাঙালি দর্শনে বিভিন্ন ধর্মের চিন্তাধারার সাথে নিজস্ব চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়ে বাঙালি তার নিজস্ব দর্শন গড়ে তুলেছে। তাই বাঙালি দর্শনে জৈনধর্মের প্রভাব অপরিসীম।
বাঙালি দর্শনে জৈনধর্মের প্রভাব : জৈনধর্ম বেদবিরোধী নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী ধর্ম। মহাবীর ২৩ জন তীর্থঙ্কর এ ধর্মের প্রবর্তক। সর্বশেষ তীর্থঙ্কর হলেন ঋষভদেব। এ ধর্ম দ্বারাও বাঙালি দর্শন প্রভাবিত। জৈনধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না এবং বেদের বিরোধিতা করা হয়। তারা কর্মবাদে বিশ্বাসী। তারা মানুষের মোক্ষ বা মুক্তিকে ‘বৈকল্য’ বলে অভিহিত করেন। তীর্থঙ্করদের নির্দেশনা মেনে চললে বৈকল্য লাভ করা যায় বলে তারা প্রচার করেন। জৈনধর্মে মানুষের মর্যাদা ও স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের দার্শনিক মতবাদের সাথে তাদের অনেক বিষয়ে সাদৃস্য রয়েছে। জৈন দর্শনে মানুষের উৎপত্তি নিয়ে তীর্থঙ্করগণ আলোচনা করেছেন। চারা ‘জীব ও অজীব’ সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। তারা জীবাত্মার চূড়ান্ত বিশ্লেষণ করে দেহ থেকে পৃথক সত্তা হিসেবে দেখিয়েছেন। তারা ছিলেন অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী। তারা ‘সাঙবাদ’ ধারণা নিয়ে আসেন যা সম্ভাব্যতা ও কার্যকারণ তত্ত্বের অনুরূপ। তারা যে দর্শন প্রচার করেন তা ছিল জীবনবাদী। বিশ্বমানবতাবাদ প্রচারে তাদের নীতিতত্ত্ব বিরল দৃষ্টান্তস্বরূপ। সমাজ ও রূাষ্ট্র দর্শন তাদের অহিংসা নীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে গান্ধীজি অহিংস আন্দোলন গড়ে তোলে। তারা মানবমুক্তির জন্য সম্যক বিশ্বাস, সম্যক জ্ঞান ও সম্যক কর্ম নামক ‘ত্রিরত্নের’ কথা প্রচার করেন। তাদের দর্শন প্রাচীন বাঙালি দর্শনকে দারুণভাবে
প্রভাবিত করেছিল ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীনকাল থেকে বাঙালি দর্শনের বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ধর্ম প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রথম দিকে সনাতন ধর্ম প্রভাব বিস্তার করলেও পরবর্তীতে জৈনধর্ম নতুন চিন্তাধারার সংযোগ ঘটায়। পরবর্তী দু এক শতকের মধ্যে জৈনধর্ম প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যায়। পরে জৈনধর্মের অনুসারীরা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে এবং অবধূত, যোগী, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে মিশে গিয়েছে।