বাঙালি জাতির নরগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

বাঙালি জাতির নরগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় লিপিবদ্ধ কর।
অথবা, বাঙালি জাতির নৃতাতত্ত্বিক উদ্ভব ও বিকাশ আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি জাতির নর গোষ্ঠীর প্রকৃতি আলোচনা কর।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : নেতৃত্বে নরগোষ্ঠী বলতে বুঝায় একই দৈহিক আকৃতিসম্পন্ন একদল লোকের সমষ্টি যারা দৈহিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অভিন্ন অর্থাৎ, অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই সাধারণ দৈহিক বৈশিষ্ট্যগুলো বংশপরম্পরায় পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত। সাধারণভাবে নরগোষ্ঠী বলতে মানব প্রজাতির এক একটি উপবিভাগকে বুঝায়,
যার সদস্যবৃন্দ কতকগুলো সাধারণ দৈহিক বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকে। প্রত্যেক উপবিভাগ ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
বাঙালি নরগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য : বাংলাদেশে আদিতে কোনো নরগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল কি না বা বাঙালি নরগোষ্ঠীর আসল পরিচয় কি তা এক কথায় বলা অসম্ভব। নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, “বাঙালি জনতত্ত্ব নিরূপণ শুধু
নৃতাত্ত্বিকদের কাজ নয়, তার সঙ্গে ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গির মিলন না হলে বাঙালিদের রহস্য উন্মোচন
প্রায় অসম্ভব বললেই চলে।” বাঙালি নরগোষ্ঠীর পরিচয় দিতে গেলে সর্বপ্রথম আমাদের জানা উচিত বাঙালি বলতে কী বুঝায়। বাঙালি
বলতে বুঝায় এমন এক জনসমষ্টি, যাদের মাতৃভাষা বাংলা, যারা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাস করে তাদেরকে আলাদাভাবে চেনা যায়।
বাঙালি জাতির উদ্ভব : আজ যেসব অঞ্চল জুড়ে বাঙালিরা বসবাস করছে সেসব অঞ্চলে কোনো প্রাচীন মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়নি। তবে কিছু কিছু পাথর পাওয়া গেছে যার বয়স আনুমানিক ৪০ লক্ষ বছর ধরা হয়। বাঙালিদের রেশ পরিচয় কি তা এক কথায় বলা মুশকিল। এ সম্পর্কে স্যার হার্বার্ট রিজলে দক্ষিণ এশিয়ার জনসমষ্টিকে সাতটি
ভাগে ভাগ করে দৈহিক বৈশিষ্ট্যে বিভিক্ত করেছেন- ১. তুর্কি ইরানি, ২. ভারতীয় আর্য, ৩. আর্য দ্রাবিড়, ৪. শার্ক দ্রাবিড়, ৫. দ্রাবিড়, ৬. মঙ্গোল দ্রাবিড়, ৭. মঙ্গোলয়েড। উল্লেখ্য, মঙ্গোল দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে বাঙালি জাতির উদ্ভব হয়েছে। ঐতিহাসিক পটভূমি : প্রাগৈতিহাসিক যুগে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আফগানিস্তানের পথ ধরে উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে
মঙ্গোলীয়গণ এদেশে প্রবেশ করে। ক্রমে তুর্কি, ইরানি এবং উত্তর ইউরোপীয়রাও ভারতে এসেছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন
রাজবংশেরও আগমন ঘটেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের ফলে পাঠান, মুঘল ও আরবীয়রা এদেশে এসেছে। এভাবে বিভিন্ন নরগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে এদেশে প্রবেশ করছে। দৈহিক বৈশিষ্ট্যের কিছু তারতম্য থেকেই যাবে। এর ফলে বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে বাঙালি জাতি একটি মিশ্র জাতি বা সংকর জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
বিভিন্ন মনীষীদের দৃষ্টিকোণ থেকে : হান্টার তাঁর ‘Annals of Rural Bengal and the Indian Mussalman’্যগ্রন্থদ্বয়ে দেখিয়েছেন যে, এদেশের মুসলমানেরা কিছু উচ্চ বর্ণের হিন্দু বাকি সব বৌদ্ধ থেকে ধর্মান্তরিত। তবে কিছুসংখ্যক লেখকরা বলেন যে, নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে বেশিরভাগ মুসলমান হয়েছে। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বিদেশি কিছু প্রভাব
থাকলেও তা নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় উল্লেখযোগ্য বিষয় হিসেবে ধরা পড়েনি।
ড. হুটন ভারত উপমহাদেশের জনসমষ্টিকে মোট আট ভাগে ভাগ করে বাঙালি নরগোষ্ঠীকে বিশ্লেষণ করেছেন। যথা :
১. নিগ্রোটো, ২. আদি অস্ট্রেলীয়, ৩. আদি মেডিটারিয়াল, ৪. সভ্য মেডিটারিয়াল, ৫. আর্মোনয়েড, ৬. আলপাইন,
৭. বৈদিক আর্য, ৮. মঙ্গোলীয়। এদের মধ্যে আলপাইন মানবগোষ্ঠীর সাথে বাঙালির দৈহিক বৈশিষ্ট্যের মিল লক্ষণীয় বলে আলপাইন মানবগোষ্ঠী মনে করেন। বাঙালি নরগোষ্ঠীর পরিচয় দিতে গিয়ে স্যার হার্বার্ট রিজলে তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Tribles and Caste of Bangal’
নামক গ্রন্থে বাঙালিদের মঙ্গোল ও দ্রাবিড় বলে উল্লেখ করেন। নাক মধ্যম থেকে চওড়া, উচ্চতা মাঝারি, তাই তিনি বাঙালিদের মঙ্গোলীয় বলে উল্লেখ করেন। অপরদিকে নাক ও চোখের বৈশিষ্ট্য দেখে মনে হয় মঙ্গোলীয়দের উপর দ্রাবিড়দের প্রভাব আছে। মোট কথা রিজলে যা বলতে চান তার পরামর্শ বাঙালিদের মঙ্গোল, দ্রাবিড় প্রভাবিত এক
সংকর জনগোষ্ঠী। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালির ইতিহাস’ পুস্তকে হিন্দু ও সংস্কৃতির উৎপত্তি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পরিবেশন
করেছেন। তাঁর মতে অস্ট্রেলীয় ও দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর ধর্মীয় আচার বিশ্বাস হিন্দু সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে। এতে বাঙালি হিন্দুদের নরগোষ্ঠীর পরিচয় ধরা পড়ে। এদের নরগোষ্ঠীতে আদি অস্ট্রেলীয় ও দ্রাবিড় প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ। তবে আর্য প্রভাবও একেবারে উপেক্ষা করা যায় না বলে নীহাররঞ্জন রায় মত প্রকাশ করেছেন। বিরাজ শংকর গুহ বলেছেন, “বাঙালি নরগোষ্ঠী হলো আদি অস্ট্রেলীয়,” আদি নিগ্রোটা ও আদি আলপাইন সংমিশ্রণে উদ্ভূত। বিরাজ শংকর গুহ আবার এই উপমহাদেশের জনসমষ্টিকে সাতটি জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছেন। যেমন ১. নিগ্রোটা,
২. প্রোটো, ৩. অস্ট্রালয়েড, ৪. মঙ্গোলয়েড, ৫. ভূমধ্যসাগরীয়, ৬. পশ্চিমের গোল মাথা, ৭. নর্ডিক। গুহু পশ্চিমের গোল
মাথাকে আবার তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- (i) আলপিনয়েড, (ii) দিনারিক, (iii) আর্মেনিয়েড। এই তিন জাতের মাথা
লাসরু এবং মুখমণ্ডল গোলাকৃতি, উচ্চতম মধ্যমাকৃতি।
গুহের ২২, ওজরাট ও বাংলার অধিবাসীদের মধ্যে এদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।” এদের মাথা বাঙালিদের সাদৃশ্য রয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন। রমাপ্রসাদ চন্দ্র উৎপত্তির দিক দিয়ে বাঙালিদের গুজরাট মহারাষ্ট্র বর্গাবাসীদের সাথে এক করে দেখেছেন। তার মতে, এরা পামীর অঞ্চলে গলিচ, তজিক ইত্যাদি আলপাইন মানবগোষ্ঠীর বংশধর। এসব
আলপাইন ভারতবর্ষের পশ্চিমে প্রথম বসতি স্থাপন করে। পরে তারা এদেশে আগমন করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, কোনো বিশেষ দু’একটা নরগোষ্ঠীর প্রভাব লক্ষ্য করে বাঙালিকে যে নরগোষ্ঠীভুক্তই করা হোক না কেন তা নির্ভুল বা সঠিক নয়। তাই এতে মনে কোনো সন্দেহ নেই যে, বাঙালি জনগোষ্ঠী কতকগুলো রেসের সংমিশ্রণে একটি সংকর জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।