অথবা, বাংলা ভাষার উদ্ভব আলোচনা কর।
অথবা, কোন ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয় আলোচনা কর।
অথবা, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতানুযায়ী বাংলা ভাষার উদ্ভব সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, কীভাবে বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশ হয়?
উত্তর৷ ভূমিকা : বাঙালি জাতির মতো বাংলা একটি সংকর ভাষা। বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণে বাংলা ভাষা পূর্ণতা লাভ করে। ভাষার উদ্ভব কীভাবে হয় তা নিয়ে পণ্ডিতদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। বাংলা ভাষার উদ্ভব সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। এ মতসমূহে ব্যাপক কোনো পার্থক্য নেই। শুধু দু-একটা স্থানে পণ্ডিতরা এ বিষয়ে এক হতে পারেননি। বাংলা ভাষা উদ্ভব সম্পর্কিত ড. সুনীতিকুমার ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশে শহীদুল্লাহর মতকে গ্রহণ করা হয়।
বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিস্তার : বাঙালি জাতি যেমন সংকর তেমনি বাংলা ভাষাও একটা সংকর ভাষা। বর্তমান বাংলা ভাষা প্রচলনের আগে গৌড় ও পুণ্ড্রের লোকেরা অসুর ভাষায় কথা বলত বলে ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ গ্রন্থে
উল্লেখ করা হয়েছে। এ অসুর ভাষার লোকেরা ছিল সমগ্র প্রাচীন বঙ্গের লোক। অসুর ভাষাকে অস্ট্রিক বুলি বলা হয়।
ড. মুহম্মদ এনামুল হক মন্তব্য করেন, “বর্তমান বাংলা ভাষা প্রচলিত হওয়ার পূর্বে আমাদের দেশে যে এ অসুর ভাষা বা অস্ট্রিক বুলি প্রচলিত ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।” বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্গত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন, আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে এ মূল ভাষার অস্তিত্ব ছিল। আনুমানিক আড়াই হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মূল ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেসব প্রাচীন শাখার সৃষ্টি হয় তার অন্যতম হলো আর্য শাখা। এ থেকেই ভারতীয় আর্যভাষার সৃষ্টি। এর সময়কাল ১২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। ভারতীয় আর্য ভাষার তিনটি স্তর-
ক. প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা,
খ. মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা ও
গ. নব্য ভারতীয় আর্যভাষা।
প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার স্তর বৈদিক ও সংস্কৃতি ভাষায় প্রচলিত ছিল। জনতার প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে মধ্য ভারতীয় আর্যভাষায় এটা আসে এবং পরে প্রাকৃত ভাষা নামে তা চিহ্নিত হয়। অঞ্চলভেদে প্রাকৃত ভাষা কয়েকটি স্তরে বিভক্ত হয়ে যায়। এর একটি হলো মাগধী প্রাকৃত। এ ভাষার প্রাচ্যতর রূপ গৌড়ীয় প্রাকৃত । তা থেকে গৌড়ীয় অপভ্রংশের মাধ্যমে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। বাংলা ভাষার উদ্ভব কাল কেউ কেউ দশম শতক বলে উল্লেখ করেন।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, বাংলা ভাষার উদ্ভব হয় সপ্তম শতকে। হাজারো বছরের পুরানো বাংলা ভাষা নানা পর্যায়ে পরিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
বাংলা ভাষার বিস্তার : বাংলা ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস আদি, মধ্য ও আধুনিক-এ তিন যুগের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করা যায়।
আদিযুগ : বাংলা ভাষা বিস্তারের আদিযুগ হলো দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সময়ের প্রধান নিদর্শন চর্যাপদ। এর ভাষায় অপভ্রংশের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। তবে এখানে বাংলা ভাষা স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়।
মধ্যযুগ : মধ্যযুগের বাংলা ভাষার বিস্তৃতির সময়কাল হলো ১২০১-১৮০০ সাল পর্যন্ত। ১২০১-১৩৫০ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষার কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তাই অনেকে একে অন্ধকার যুগ বলে অবহিত করেন। এ সময় ভাষা বিবর্তিত হচ্ছিল বলে অনেকে মনে করেন। মধ্যযুগের অন্যতম প্রথম নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। এর ভাষা চর্যাপদ থেকে অনেক মার্জিত ও পরিশোধিত। মধ্যযুগে বাংলা ভাষা বিবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। এ সময় অনেক ধরনের সাহিত্যকর্ম পাওয়া যায়। মঙ্গলকাব্য, পুথি সাহিত্য, অনুবাদ কাব্য এর মধ্যে অন্যতম। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করে। এটা হলো জীবনী সাহিত্য।
মধ্যযুগের সর্বশেষ কবি ভারতচন্দ্র রায় গুনাকর। তিনি তার লেখায় অনেক আরবি ও ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন। এর ফলে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ভাষার শব্দ প্রবেশ করে যা বাংলা ভাষার সমৃদ্ধিতে কাজ করে।
আধুনিক যুগ : ১৮০১ সাল থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত আধুনিক কাল। এ সময় বাংলা গদ্যের বিকাশ লাভ করে। প্রথম দিকে বাংলা গদ্যে কিছু জড়তা থাকলেও পরে তা পরিমার্জিত রূপধারণ করে। এভাবে বাংলা ভাষা তার বিকাশকে পূর্ণতা দানে সক্ষম হয়।
উপসংহার : পরিশেষে এটাই বলা যায় যে, বাংলা ভাষা নানা বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। ইন্দো- ইউরোপীয় মাতম ভাষা গোষ্ঠীর মাতম থেকে বাংলার ভাষার উৎপত্তি হলেও স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব পরিসরে এসে স্বকীয়তা লাভ করে । এর পূর্বে দীর্ঘ সময় বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ভাষার নানা শব্দ প্রবেশ করে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধি লাভ করে।