অথবা, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক CEDAW সনদের সংরক্ষণকৃত ধারাগুলো উল্লেখ কর। এ ধারাগুলো বাংলাদেশ সরকারের জন্য কতটুকু যুক্তিসংগত? আলোচনা কর।
CEDAW সনদের কোন কোন ধারাগুলো বাংলাদেশ সরকার সংরক্ষণ করেছে? এ
সংরক্ষণের জন্য যে সকল যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছে তা পর্যালোচনা কর।
উত্তরা ভূমিকা : আমাদের সমাজে নারীর অবস্থানকে কতটা অধস্তন করে রাখা হয়েছে, তা সমাজের দিকে একটু দৃষ্টি দিলেই যে কেউ সহজেই অনুমান করতে পারবে। শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয় বরং সারাবিশ্বে নারীরা
অর্থনৈতিক, সামাজিক তথা সামগ্রিকভাবে অবহেলিত। যুগ যুগ ধরে নারীর প্রতি চলে আসা বৈষম্য দূর করার জন্য জাতিসংঘ দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ এ লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালকে ‘বিশ্ব নারী বর্ষ’ এবং ১৯৭৬-৮৫ সালকে ‘নারী দশক’ ঘোষণা করে। আর এ ঘোষণার প্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে CEDAW বা ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ’ গৃহীত হয়। এ সনদটি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ নিজ নিজ দেশে বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সনদটির কয়েকটি ধারা
আপত্তিসহ দলিলে স্বাক্ষর করে।
CEDAW কি : CEDAW সনদ হলো নারী অধিকারের আন্তর্জাতিক বিল। নারীর প্রতি সকল প্রকারের বৈষম্য দূর করা এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ সনদ বা চুক্তি হচ্ছে CEDAW। ইংরেজিতে একে বলা হয় ‘Convention on the elimination of all
forms of discrimination against women.’৷ CEDAW এ স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা : ১৯৮০ সালের ১ মার্চ থেকে এ সনদে স্বাক্ষর শুরু হয়। সে সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ১৭৭টি দেশ এ সনদে স্বাক্ষরদান করে। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে স্বাক্ষর কার্যকর হয়।
CEDAW সনদের মূল বক্তব্য : CEDAW দলিলের মর্মবাণা , সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে যুগ যুগ ধরে নারী যে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে আসছে, সে ভূমিকার যথাযথ স্বীকৃতি এবং সার্বিকভাবে গোটা বিশ্বের শান্তি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা স্থাপন করা। এর জন্য আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয়
আইনের সংস্কার, আইন প্রয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ইত্যাদি যা কিছু প্রয়োজন, সনদে শরিক রাষ্ট্রগুলো তার সকল ব্যবস্থা গ্রহণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
CEDAW সনদের ধারা : CEDAW সনদে ৩০টি ধারা রয়েছে। এ ধারাগুলো তিন ভাগে বিভক্ত। যথা :
(ক) ১-১৬ ধারায় নারীর প্রতি কি ধরনের বৈষম্য করা হয় অর্থাৎ, নারী বৈষম্যের বন কি সেগুলো আলোচনা করা হয়েছে
(খ) ১৭-২২ ধারায় নারীর প্রতি বৈষম্যগুলো কিভাবে দূর করা যায় তা আলোচনা করা হয়েছে।
(গ) ২৩-৩০ ধারায় CEDAW এর প্রশাসন কিভাবে চলবে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
CEDAW ও বাংলাদেশ : ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ এ দলিল অনুমোদন করে স্বাক্ষর করেছে। অনুমোদনের সময়ে বাংলাদেশ সরকার ধারা-২, ধারা-১৩ এর (ক) এবং ১৬ এর ১ এর (গ) ও (চ) ধারাগুলো আপত্তিসহ সংরক্ষিত রেখে) স্বাক্ষর করেছে। পরবর্তীতে আপত্তিগুলো তুলে নেওয়ার ব্যাপারে জাতীয় পর্যায়ে গঠিত রিভিউ কমিটির
সুপারিশক্রমে, ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই ১৩ (ক) ও ১৬ এর ১(চ) ধারাগুলো থেকে বাংলাদেশ সরকার তার আপত্তি প্রত্যাহার করে।নয়েছে। তবে ধারা ২ এবং ১৬.১(গ) এর উপর আপত্তি বহাল রয়েছে।
CEDAW এর ধারাগুলো সংরক্ষণের পক্ষে যুক্তি : CEDAW এর কতিপয় ধারা ও উপধারা অনুমোদন না করার পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে যুক্তি দেখানো হয়েছে তা হলো বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ, তাই মুসলিম ধর্মের বিধানসমূহকে এ সংরক্ষণের পক্ষে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। বলা হয়েছে যে, এ ধারাগুলো পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ্র ভিত্তিতে গড়ে উঠা শরীয়া আইনের পরিপন্থি হওয়ায় সংরক্ষণ আরোপ করা হয়েছে।
সরকারের এ সংরক্ষণ কতটুকু যুক্তিসংগত : সংরক্ষণের পক্ষে যেসব যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছে তা পর্যালোচনা করলে এ কথা সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় অনুশাসনের আলোকে এ ধারাগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু এ সনদটি পূর্ণ অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশের বৃহত্তর নারী সমাজ সক্রিয় আন্দোলন করে আসছেন।
শত শত বছর ধরে নারীর প্রতি অবহেলা, তাদের পশ্চাদপদতা ও নির্যাতনের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ কর্তৃক CEDAW৷ প্রণীত হয়েছে- ‘International Bill of Rights’ হিসেবে। এ সনদের কোনো ধারার সংরক্ষণের নৈতিক অধিকার/ভিত্তি থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। মানবাধিকারের বিবেচনায় এ সংরক্ষণ নৈতিকতা বিবর্জিত। কারণ-
১. সংবিধান লংঘন করা : সরকার ২নং ধারা সংরক্ষণের মাধ্যমে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কোনো নতুন আইন প্রণয়ন, পুরাতন আইনের সংস্কার ও সংশোধনের বিষয়টি পুরোপুরি নাকজ করে দিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক কোনো আইন
সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারবে না। কাজেই, সরকার ধারা-২ এর অস্বীকৃতি জানিয়ে নারীকে তার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।
২. শরীয়া আইন : ধারাগুলো সংরক্ষণের পক্ষে বাংলাদেশ সরকার যুক্তি দেখিয়েছে যে, এগুলো মুসলিম শরীয়া আইনের পরিপন্থি। কিন্তু এ সংরক্ষিত ধারাসমূহ শরীয়া আইনের পরিপন্থি কেন তা সরকার যৌক্তিকভাবে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া পারিবারিক অধিকারের ক্ষেত্রে সরকার তার বিচারবিভাগীয় ও আইনগত উভয় কাঠামোতে তাৎপর্যপূর্ণ সংস্কার সাধন করেছে। যার দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে, শরীয়া আইনও অপরিবর্তনীয় ও অলংঘিত কিছু নয়, বরং মানব জাতি তথা নারী সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে শরীয়া আইনও পরিবর্তন করা যায়। এক্ষেত্রে দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়,
আইয়ুবখান কর্তৃক ১৯৫২ সালে মুসলিম শরীয়া আইন সংস্কার।
৩. বিবাহবিচ্ছেদের সময় সমান অধিকার : ধারা-১৬ অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের বিষয় বিধৃত হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এর গুরুত্ব অপরিসীম। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৬১ সালে যেখানে মাত্র ০.৫% বিবাহিত জনসংখ্যার একাধিক স্ত্রী ছিল তা পর্যায়ক্রমে ১৯৭৪ সালে ১%, ১৯৮১
সালে ৪.৩% এবং ১৯৯১ সালে ৬.৫% এ দাঁড়িয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে প্রতি ১৫ জন বিবাহিত জনসংখ্যার মধ্যে একজন বহুবিবাহ করে থাকেন। এটা রোধ করতে হলে অবশ্যই প্রয়োজন আইনের সংস্কার। কাজেই, এক্ষেত্রে সংরক্ষণ তুলে নেওয়া হলে যৌক্তিক কারণে বিবাহবিচ্ছেদ অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। ফলে হ্রাস পাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বহুবিবাহ ।
৪. ভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা : যদিও বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ তথাপি এখানে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাও কম নয়। এসব ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাও কম নয়। এসব ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা শরীয়া আইনের আওতার বাইরে। শরীয়া আইন শুধু মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু শরীয়া আইনের পরিধির বাইরে অন্যান্য অমুসলিম নারীরা সবাই ঠিকই CEDAW সনদের প্রদত্ত সকল অধিকার পূর্ণ মাত্রায় ভোগ করতে পারবে। তাই এক্ষেত্রে সংরক্ষণ
আরোপ CEDAW সনদে বিধৃত ধর্মীয় ভিত্তিতে নারীর প্রতি সকল বৈষম্য বিলোপের ঘোষণার পরিপন্থি।
৫. মৌলিক অধিকার লংঘন: CEDAW সনদের ধারা ১৩(ক), ১৬.১(গ) ও (চ) এর সংরক্ষণ বাংলাদেশ সংবিধানের ২৬, ২৭, ২৮ ও ২৯ নং ধারায় বর্ণিত নারী-পুরুষের সমান অধিকারের ঘোষণার পরিপন্থি। অর্থাৎ, এখানে নারীদের মৌলিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে।
৬. সম্পূরক ধারা : CEDAW এর কোনো বিশেষ ধারার সংরক্ষণ অন্য ধারার অনুমোদনকে অর্থহীন করে তোলে। কারণ, এর ধারাগুলো একে অপরের সম্পূরক ও পরিপূরক।
৭. অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ : ইরাক, ইয়ামেন, তিউনিশিয়া, মিশরের মত দেশগুলো ইতোমধ্যে এসব ধারার সম্মতি দিয়েছে এবং এসব দেশে শরীয়া আইন অনুসারিত হচ্ছে। তাহলে কেন বাংলাদেশ সরকার শরীয়া আইনের নামে তা সংরক্ষণ করবে?
৮. সদস্য রাষ্ট্র : CEDAW সনদ বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক CEDAW কমিটি এর সদস্য বাংলাদেশ। কাজেই, কমিটির অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে অন্যান্য রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ধারাগুলো সংরক্ষণ করাকে
কোনোভাবেই সমর্থন দেয়নি।
- Platform For Action (PFA) : বেইজিং ঘোষণা (৯৫) এর PFA পূর্ণ অনুমোদনের পর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ধারাগুলোর উপর সংরক্ষণ বজায় রাখার আর কোনো যৌক্তিকতা নেই।
১০. ভাবমূর্তি উজ্জ্বলকরণ : CEDAW সনদের উপর থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে।
১১. আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা : প্রতিটি রাষ্ট্রই কিছু আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার অধীনে থাকে, নিজের ইচ্ছামতো চলতে পারে না। বাংলাদেশও জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত নারী-পুরুষের সমতা এবং নারীর প্রতি বৈষম্যহীনতার নিশ্চয়তা প্রদানের ঘোষণার প্রতি দায়বদ্ধ। আর তাই বলা যায় যে, ধারাগুলোর সংরক্ষণ নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা নিশ্চিতকরণে আন্তর্জাতিক আইনের অধীন। বাংলাদেশ সরকারের আইনই বাধ্যবাধকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, CEDAW সনদ হলো বিশ্বব্যাপী অবহেলিত ও পশ্চাদপদ নারী সমাজের উন্নয়নে একটি আন্তর্জাতিক প্রকাশ। এ সনদের মূল লক্ষ্য হলো নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করা। অথচ সরকার এ সনদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন না দিয়ে ধর্মীয় অনুশাসন ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কাছে মাথা নত করেছে। অন্যদিকে, অশ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছে সংবিধানে নারীর যে সমঅধিকার দেওয়া হয়েছে তার প্রতিও। পরিশেষে আমরা বলতে
পারি যে, ধর্মীয় আইনের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান থেকে বিরত থেকে তাকে যুগের চাহিদা অনুসারে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান করলে দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। আর ব্যাপারে প্রত্যেক সচেতন নাগরিকেরই এগিয়ে আসা উচিত। অন্যথায়, নারীর অধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন কখনোই সম্ভব হবে না।