অথবা, বাংলাদেশে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের ক্রমবিবর্তন সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : আধুনিক রাষ্ট্র জবাবদিহিমূলক এবং গণতান্ত্রিক। জনগণের সর্বাধিক কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রগুলো সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আধুনিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পরিসর বৃদ্ধির ফলে কেন্দ্রীয় সরকার এককভাবে যাবতীয় কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে অসমর্থ। তাই এসব কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পাদন করার লক্ষ্যে সরকারের কেন্দ্রীয় পর্যায় হতে ভাগ করে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের আবির্ভাব ঘটে। মূলত রাষ্ট্রের কার্যের সমন্বয় সাধনকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারকে সদা ব্যস্ত থাকতে হয় এবং সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য বা সরকারি সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য কাজ ও ক্ষমতার বিভাজন করা হয় এবং গঠিত হয় স্থানীয় প্রশাসন।
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন পদ্ধতির ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস : ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ভারতীয় নীয় উপমহাদেশে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়। বিকেন্দ্রীকরণ কমিশন তার রিপোর্টে বলেছেন, “প্রশাসনের সাথে
২ই জনগণকে সংশ্লিষ্ট করার জন্য যে সৌধ রচনা করা হবে তার স্থায়ী ভিত্তি অবশ্যই হবে গ্রাম।” উল্লেখ্য, ব্রিটিশ রাজত্বের পূর্ব মুহূর্তে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্য গ্রাম্য জীবনে অবক্ষয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পায় ভয়ংকরভাবে। তাছাড়া ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথম থেকেই কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই এর মত শহরের উন্নতি সাধিত হতে থাকে। এসব শহরে সর্বপ্রথম স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা সংগঠনের প্রচেষ্টা করা হয় নিম্নে বর্ণিত পদ্ধতিতে :
১. ১৭৯৭ সালের মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন ব্যবস্থা : ১৭৯৩ সালের সনদ আইনে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গঠনের কর্তৃত্ব দান করা হয় গভর্নর জেনারেলের উপর। ব্রিটিশ ব্যবস্থার অনুকরণে ভারতের প্রেসিডেন্সি শহরগুলোতে সর্বপ্রথম স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গড়ে ওঠে। ১৮৬৩ সালে সনদ আইনের মাধ্যমে ১৮৫৬ সালে প্রবর্তিত আইনের পরিবর্ধন করে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের কাঠামোর মৌল পরিবর্তন সাধন করা হয়। নতুন আইনে কপোরেশনের জন্য একজন বেতনভোগী সভাপতির ব্যবস্থাও করা হয়। এখন কর্পোরেশনের ‘Justice of the peace’ এ সংখ্যা ছিল সর্বমোট ১২৯ জন।
২. ১৮৫০ সালের পৌরসভা আইন : ১৮৫০ সালে ‘Bengal Council’ এ একটি পৌরসভা আইন প্রণীত হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য কোনো সরকারই এ ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রতি নজর দিতে পারেনি। এরূপ অবস্থায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালের ২৭ অক্টোবর ‘Basic Democraties Order’ ঘোষণা করেন এবং সারা দেশে স্থানীয়
সংস্থাসমূহের গঠনতন্ত্র ঘোষণা করেন।
৩. স্বাধীন বাংলাদেশে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার : ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করার জন্য সচেষ্ট হন। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ৭নং আদেশ অনুযায়ী প্রচলিত সকল স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বাতিল ঘোষিত হয়। পরে রাষ্ট্রপতির আদেশে বাতিলকৃত থানা কাউন্সিলকে পুনরায় বহাল করা হয় থানা উন্নয়ন কমিটি রূপে। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশে প্রণীত সংবিধানে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা সম্পর্কে কিছু কিছু ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ১৯৭৫ সালের শেষদিকে দেশে সামরিক আইন প্রশাসক সংগঠিত হলে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে আরো কিছু
পরিবর্তন সাধিত হয়। ১৮৬৪ সালে মিউনিসিপ্যাল উন্নয়ন আইন নামে একটি আইন পাস হয়। এ আইনানুযায়ী সরকার সাত জন স্থায়ী কমিশনারকে পৌরসভার কমিশনার ন
িয়োগ করার ক্ষমতা লাভ করেন।
৪. ১৮৭০ সালের গ্রাম্য চৌকিদারি আইন : ১৮৭০ সালে সরকার গ্রাম্য চৌকিদারি আইন প্রণয়ন করেন। এ আইনের ফলে ১০/১২ বর্গমাইলব্যাপী এলাকাকে ইউনিয়ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসব ইউনিয়নে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট পঞ্চায়েত কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয় । পঞ্চায়েতগুলো ‘চৌকিদার’ নামক পাহারাদার নিয়োগ করতেন এবং তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেন। এ আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি পত্তন হয়।
৫. ১৮৮৩ সালের স্বায়ত্তশাসন আইন : ১৮৮৩ সালে সরকার পৌরসভা ও পঞ্চায়েত সম্পর্কে আরো দুটি আইন প্রণয়ন করেন। পৌরসভা সংক্রান্ত আইনে প্রস্তাব করা হয় যে, প্রত্যেকটি উন্নত মিউনিসিপ্যালটিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা হবে। আর অন্যটিতে প্রস্তাব করা হয় যে, গ্রামাঞ্চলে কোনো কোনো স্থানে ইউনিয়ন কমিটি গঠন করা হবে। মিউনিসিপ্যাল সংক্রান্ত বিলটি আইনে পরিণত হয় ১৮৮৪ সালের ২৯ মার্চ ।
৬. ১৮৮৫ সালের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইন : স্বায়ত্তশাসনের ইতিহাসে ১৮৮৫ সালের আইন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ সময়ের রাজনৈতিক অবস্থা আর গণদাবি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের গতি আরো ত্বরান্বিত করে। তদানীন্তন -ভাইসরয় লর্ড রিপন এর শাসন সংস্কারের মাধ্যমে ১৮৮৫ সালের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইন প্রণীত হয়। এ আইনের অধীনে গ্রামাঞ্চলে দুটি পর্যায়ে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ।
৭. ১৯১৯ সালে স্থানীয় গ্রাম্য স্বায়ত্তশাসন আইন : ১৯১৯ সালে স্থানীয় গ্রাম্য স্বায়ত্তশাসন আইন প্রণীত হয়। এরই ভিত্তিতে বাংলাদেশের সর্বত্র ইউনিয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। সার্কেল অফিসার এ বোর্ডের কার্যক্রম তদারকি করতেন। এছাড়া ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে উপমহাদেশে কে স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পর এ ব্যবস্থা আরো নবরূপ ধারণ করে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর ১৯৭৩ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সরকার ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা আইনে এ ব্যবস্থার কিছু রদবদল করে এবং জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত হলে চূড়ান্তভাবে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা চালু করা হয়। এ আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন পঞ্চায়েতগুলো ইউনিয়ন পরিষদ এবং নগর পঞ্চায়েতগুলো পৌরসভা নামে চিহ্নিত হয়। এভাবে ভারতীয় সে উপমহাদেশে ব্রিটিশ সরকার থেকে শুরু করে পরবর্তীতে বাংলাদেশে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন পদ্ধতি বিকাশ লাভ করে । যথা :ক.মহকুমা পর্যায়ে লোকাল বোর্ড এবং জেলা পর্যায়ে জেলা বোর্ড।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে পাক-ভারত উপমহাদেশের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের বিবর্তন হতে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বহু চড়াই উতরাই পেরিয়ে আজকের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার এরূপ লাভ করেছে। স্থানীয় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এ সংস্থায় গুরুত্ব অপরিসীম।